শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫ ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
 
শিরোনাম:


সংসারের মাঠে ‘গেম ওভার’
মীর আব্দুল আলীম
প্রকাশ: শনিবার, ১০ মে, ২০২৫, ৪:৩৮ PM

সম্প্রতি দেশের একজন চৌকস, কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ কর্মকর্তা নিজের জীবন দিয়ে আমাদের সামনে রেখে গেলেন এক গভীর প্রশ্নবোধক চিহ্ন—পুরুষের মানসিক যন্ত্রণা কি সমাজ সত্যিই বোঝে? এত সুনাম, সামাজিক মর্যাদা, সফল কর্মজীবন—সবকিছু থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন? কোথায় ছিল সেই ফাঁকটা, যা শেষমেশ তাকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য করল?

আমরা সমাজে প্রতিনিয়ত নারী অধিকার, নারী নির্যাতন, নারী উন্নয়ন নিয়ে কথা বলি, আইন করি, সচেতনতা তৈরি করি। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং সময়োপযোগী। কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছি, এই সমাজেই পুরুষেরা কতটা নিঃসঙ্গ? কতটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় তারা প্রতিদিন ভেঙে পড়ছে—নিঃশব্দে, নিঃস্বরে, নিরালায়?

একজন পুরুষকে আমরা দেখি "রক্ষক", "সংসারের অভিভাবক", "দায়িত্ববান", "অশ্রুহীন" এক অবিনাশী চরিত্র হিসেবে। তার চোখের জল সমাজে নিষিদ্ধ। সে কাঁদতে পারে না, কষ্ট জানাতে পারে না, এমনকি বলতে পারে না—"আমি ভেঙে পড়েছি", "আমি কষ্টে আছি", "আমার মানসিকভাবে সাহায্য দরকার।"

পরিবার—যা হবার কথা ছিল শান্তির আশ্রয়স্থল—আজ অনেক সময় হয়ে উঠছে একজন পুরুষের নিঃশ্বাস রুদ্ধ হবার কারণ। স্ত্রী-স্বামী-শ্বাশুড়ি বা সন্তানের মাঝে ঘূর্ণিপাক খাওয়া সম্পর্কগুলো যখন সম্মানহীনতায় পর্যবসিত হয়, তখন একজন পুরুষ কোথায় যাবে? মা বনাম স্ত্রী দ্বন্দ্ব অনেক পুরুষের জীবনে ভয়াবহ মানসিক টানাপোড়েনের কারণ। একজন ছেলে মা ও স্ত্রীর মাঝে ভারসাম্য রাখতে চায়, উভয়কে ভালোবাসে, কিন্তু যখন একপক্ষ অপর পক্ষকে অবমাননা করে, অবিশ্বাস করে, তখন সে হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ—যার না আছে আত্মীয়তা, না ভালোবাসার নিরাপদ আশ্রয়।

সেই আত্মঘাতী পুলিশ কর্মকর্তার ঘটনা থেকে আমরা কি শিখছি? নাকি এটিও হয়তো কিছুদিন আলোচনার পর তলিয়ে যাবে বিস্মৃতির অতলে?
আমি এক বন্ধুর কথা বলেছিলাম, সে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সংসারে নিঃসঙ্গ। তার স্ত্রী তাকে মানসিকভাবে অবজ্ঞা করে, তার মা প্রায়শই অপমানিত হন, সন্তানরা তার প্রতি দুর্ব্যবহার করে। একদিন সে কাঁদতে কাঁদতে বলল—"আমি শুধু চাই একজন মানুষ জিজ্ঞেস করুক, আমি কেমন আছি!" কী নির্মম বাস্তবতা—একজন পুরুষ কেবল ভালোবাসা আর সম্মানের ক্ষুধায় ক্ষয়ে যাচ্ছে, অথচ সমাজ বলছে—"তুমি তো পুরুষ, তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাও না।"

এ সমাজে পুরুষরা শিখে এসেছে কষ্ট চাপা দিতে, অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে। কর্মস্থলে কঠোর, ঘরে সংবেদনশীল—এই দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে করতে তারা ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। নারী যদি পরিবারে ভালোবাসা না পায়, সে চিৎকার করে বলে, সমাজ বলে—"এই কষ্ট অন্যায়।" কিন্তু পুরুষ যদি পরিবারে অসম্মান পায়, লাঞ্ছিত হয়, তার মুখে বন্ধ ঠোঁট—কারণ সে জানে, সমাজ বলবে—"তুমি তো মেয়ে না!"

আমরা কতটা দ্বিচারী হয়ে গেছি!
নারীর কান্না সমাজ শোনে, পুরুষের কান্না দেয়ালে গায়ে লাগে না। নারীর নির্যাতন আলোচনায় উঠে আসে, পুরুষের নিপীড়ন হয় ব্যঙ্গবিদ্রূপের খোরাক। অথচ বাস্তবতা হলো, মানসিক অত্যাচার লিঙ্গভেদে ঘটে না—এটি একটি নীরব ঘাতক, যা ধীরে ধীরে একজন মানুষকে আত্মার মৃত্যু দেয়।

আজ যে পুলিশ কর্মকর্তা চলে গেলেন, হয়তো তিনি কাউকে বলতে পারেননি তার যন্ত্রণার কথা। হয়তো তার দাম্পত্য জীবনে ছিল অবিশ্বাস, অবমাননা, অথবা এমন একটি সম্পর্ক, যা শুধুই দায়িত্বের ভার, ভালোবাসার আশ্রয় নয়। হয়তো অফিসে তিনি ছিলেন ‘স্যার’, কিন্তু ঘরে ছিলেন শুধুই এক নিঃস্ব, অভিমানী মানুষ।
একদিকে মা বলেন, “আমার গর্ভে ধরে তোকে মানুষ করেছি।” অন্যদিকে স্ত্রী বলেন, “সব ফেলে আমি তোমার সঙ্গে এসেছি, আমার আত্মত্যাগ কম কীসে?”এই দুই মহিলার যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষটি হয়ে যায় একজন ‘দুই দিকের দরজার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা পিয়ন’। কোনো দিকে যেতে পারেন না, দাঁড়িয়েই যান।
আমরা যখন বলি “পুরুষতান্ত্রিক সমাজ”, তখন বুঝি যেন পুরুষই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ এই তথাকথিত নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিটিই যদি নিজের কষ্ট বলতে না পারে, নিজের ভালোবাসার জায়গাটিও হারিয়ে ফেলে, তাহলে তাকে আর কতদিন 'শক্তিশালী' বলে চালানো যায়?

সমাজ, মিডিয়া, আইন, শিক্ষা—সবখানে এখন দরকার ভারসাম্য। দরকার পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা। দরকার বাবাকে ভালোবাসতে শেখানো, ছেলেকে কাঁদার অধিকার দিতে শেখানো। কারণ, কাঁদে শুধু নারী নয়—পুরুষও কাঁদে। তবে তারা কাঁদে একা, নিঃশব্দে, হয়তো আলমারির দরজা বন্ধ করে অথবা ওয়াশরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। তাদের কান্না গলায় আটকে থাকে, কারণ তারা জানে—“আমার কান্না কেউ বুঝবে না।”

একটা সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে হলে, আমাদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই শিখাতে হবে—একটি পরিবারে ভালোবাসা ও দায়িত্ব উভয়ের জন্যই সমান। পরিবারে যেন কোনো পক্ষ অবহেলিত না হয়, অসম্মানিত না হয়।

সবচেয়ে বড় কথা, আমরা যারা বাইরে থেকে দেখি, যারা কিছু করতে পারি—তারা যেন থেমে না যাই এইসব মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে। সময় এসেছে পুরুষের নিঃশব্দ যন্ত্রণাকে শব্দে রূপ দেওয়ার।

পলাশের আত্মহত্যা আমাদের ঘুম ভাঙানোর মতো এক চরম বাস্তবতা। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সামাজিক কাঠামোর ভেতরে ধীরে ধীরে জন্ম নেওয়া নীরব আত্মহননের প্রতীক। আমরা চাই না, আমাদের সন্তানরাও একদিন পলাশ হয়ে যাক।
ঘর মানে যুদ্ধ নয়, ঘর মানে আশ্রয়। ঘর মানে ভালোবাসা, সংলাপ, বোঝাপড়া। একটা মানুষ কতোটা একা হলে সে নিজের অস্ত্র তাক করে নিজের বুকেই গুলি চালায়—এই প্রশ্নটি আমাদের বিবেককে নাড়া দিক।
আমরা চাই, সংসার হোক একটি সহমর্মিতার স্কুল, ভালোবাসার পাঠশালা। যেখানে মা-বউ একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং বন্ধু হবেন। যেখানে পুত্র-স্বামী কেবল দায়বদ্ধ একজন মানুষ নয়, ভালোবাসার পূর্ণ মর্যাদায় একজন অনুভূতিপূর্ণ মানুষ হতে পারবেন।
এখনো সময় আছে—এই সমাজ, এই সংসার, এই মূল্যবোধকে বদলাতে হবে। নয়তো প্রতিদিনই কোনো না কোনো ঘরে আরেকটি পলাশ নিঃশব্দে হারিয়ে যাবে।
আজ যারা চলে যাচ্ছেন, তারা নয়—আমরা ব্যর্থ। তাদের কান্না শুনিনি বলেই, তারা চিরতরে নীরব হয়ে গেছে। আমরা এমনটা আর চাই না।

লেখক: সমাজ গবেষক,  মহাসচিব -কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের। www.mirabdulalim.com







আরও খবর


প্রকাশক: এম এন এইচ বুলু
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মাহফুজুর রহমান রিমন  |   উপদেষ্টা সম্পাদক : রাজু আলীম  
বিএনএস সংবাদ প্রতিদিন লি. এর পক্ষে প্রকাশক এম এন এইচ বুলু কর্তৃক ৪০ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, বুলু ওশেন টাওয়ার, (১০তলা), বনানী, ঢাকা ১২১৩ থেকে প্রকাশিত ও শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
ফোন:০২৯৮২০০১৯-২০ ফ্যাক্স: ০২-৯৮২০০১৬ ই-মেইল: spnewsdesh@gmail.com