বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫ ২ শ্রাবণ ১৪৩২
 
শিরোনাম:


জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান
বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক
রাজু আলীম
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১ জুলাই, ২০২৫, ৪:৩৫ PM

বাংলাদেশের ইতিহাসে জুলাই মাসটি একটি বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। শুধু ক্যালেন্ডারের একটি সাধারণ মাস নয়, এটি এমন একটি সময় যা দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইতিহাসে গভীর ছাপ ফেলেছে। অন্যান্য মাসের তুলনায় জুলাইয়ের বিশেষত্ব এর জনজীবনে সৃষ্ট সচেতনতা ও সক্রিয় প্রতিবাদের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো শুধু বর্তমান পরিস্থিতি পরিবর্তন করেনি, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক দিশা এবং নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশের পথ সুগম করেছে।
২০১৯ সালের জুনে শুরু হওয়া কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল এই পরিবর্তনের শুরু। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই প্রথার মাধ্যমে সরকার নিজের অনুগতদের নিয়োগ নিশ্চিত করায় অধিকার বঞ্চিতরা অভিযোগ করে আসছিলেন, রাষ্ট্রের এই নিয়মের অপব্যবহারে প্রতিভা ও যোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে, এবং সুযোগ-অসুবিধার অনৈতিক ব্যবধান তৈরি হয়েছে। তরুণ ছাত্রছাত্রীরা এই অন্যায় প্রথার বিরুদ্ধে সড়কে নামেন, যার মাধ্যমে শুরু হয় নতুন এক রাজনৈতিক চিন্তার উন্মেষ। প্রথমদিকে এই আন্দোলন ছিল শুধু একটি নির্দিষ্ট দাবি কেন্দ্রিক, তবে সরকার কর্তৃক পুলিশের সহিংস দমন-পীড়ন এবং নিরীহ আন্দোলনকারীদের হত্যা এই প্রতিবাদের মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন এই রাজনৈতিক উত্তেজনার পরিবেশকে আরও প্রজ্বলিত করে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন মূলত তরুণদের নিরাপত্তা ও সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শুরু হলেও এটি সরকার বিরোধী গনআন্দোলনে পরিণত হয়, কারণ সরকার ও পুলিশের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তরুণ সমাজের ক্ষোভ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। সরকারি অফিস ও যানজট, দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা, আওয়ামী লীগের অবিচার ও অন্যায়ের সংস্কৃতি, স্বেচ্ছাচারি বল প্রয়োগ সহ নানা সামাজিক সমস্যা এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে পুলিশি নির্যাতনের যে ঘটনা শহীদ মিনারের কাছে ঘটেছিল, তা দেশের জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
এছাড়াও ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনও ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের একটি স্পষ্ট প্রতিবাদ। ভ্যাট বৃদ্ধির প্রস্তাবনা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তোলার প্রয়াশঃ বিশেষত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য। শিক্ষার্থীরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচি নেয় এবং এর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক নীতিমালার প্রতি জনসাধারণের অসন্তোষ প্রকাশ পায়।
এই দুটি আন্দোলনের মাঝেই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক চেতনা ও প্রতিবাদের ধারার জন্ম হয়। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের দখলে না থেকে স্বাধীন ও সচেতন নাগরিক হিসেবে সড়কে নেমে আসে। এই নতুন রাজনৈতিক বোধ তাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করে। জনতার অংশগ্রহণ বর্ধিত হয়, এবং আন্দোলনগুলো কেবল শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সাধারণের মাঝে বেরিয়ে আসতে শুরু করে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘদিনের শাসনামল দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে কঠোর এক সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে একপাক্ষিক ও নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির মাধ্যমে ক্ষমতা এককেন্দ্রীকরণের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা বিরোধী মত ও রাজনৈতিক বহুত্ববাদের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছিল।

সরকার বিচার বিভাগ, প্রশাসন এবং গণমাধ্যমকে নিজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে বিরোধী দলের ক্রমাগত নিপীড়ন ও দমন-পীড়ন চালিয়ে গিয়েছিল। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের অবৈধ কারাবরণ এবং সংবাদমাধ্যমের উপর ভয়াবহ চাপ সরকারের ব্যবস্থাপনাকে দুর্বল ও অবিচারমুখী করে তোলে। এই শাসনব্যবস্থার ফলে দেশের সাধারণ মানুষ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নানা রকম নির্যাতন ও হুমকির মুখে পড়তে থাকে।
দুর্নীতির ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ সরকারের নাম ছিল বহুল আলোচিত। রাষ্ট্রীয় প্রকল্পগুলোতে জনবসতিতে অনিয়ম, উন্নয়ন কাজের ব্যয় বৃদ্ধি, সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর উপর অতিরিক্ত কর আরোপ, এবং সরকারি তহবিলের অপব্যবহার সাধারণ মানুষকে হতাশ করে। এই দুর্নীতি ও অনিয়ম কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি করেনি, বরং দেশের সামাজিক কাঠামো ও প্রশাসনিক কাঠামোর ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

আন্তর্জাতিক রিপোর্ট ও দেশের সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা তথ্য বলছে, সরকারি প্রকল্পে টেন্ডারবাজি, ঘুষ ও অনিয়মের কারণে বিপুল অর্থ অপচয় হয়েছে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে এই দুর্নীতি সাধারণ মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। এছাড়া, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারও ব্যাপক হারে ঘটে, যা সামাজিক অবক্ষয়ের নতুন মাত্র সৃষ্টি করে।
সামাজিক অবক্ষয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, দেশের নানা সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে অবহেলা ও অসংগতি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মৌলিক সুবিধার অভাব, শ্রমিকদের অধিকারহীনতা, নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য এই অবক্ষয়ের স্পষ্ট প্রতিফলন। দেশের পোশাক শিল্প, যা বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস, সেখানে শ্রমিকদের শোষণ এবং কাজের পরিবেশের দিক থেকে সংকট ছিল চোখে পড়ার মতো। এসব সমস্যা দেশের সামাজিক সুরক্ষা ও সামগ্রিক উন্নয়নকে ব্যাহত করেছে।
এই পরিস্থিতিতে জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ এবং অনাস্থার জন্ম নেয়। তরুণ প্রজন্ম, যারা দেশের ভবিষ্যত ধারক, তারা এই অবিচারের বিরুদ্ধে এক হয়ে প্রতিবাদে মুখরিত হয়। কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো ঘটনা ছিল সেই বিস্ফোরক বারুদ, যা বৃহত্তর গণ–অভ্যুত্থানের আগুন জ্বালায়।

এই আন্দোলনগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এক নতুন উত্তেজনা ও পরিবর্তনের দাবিকে জন্ম দেয়। তরুণরা শুধু নিজের স্বার্থে নয়, দেশের সার্বিক ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতার জন্য লড়াই শুরু করে। তাদের এই উত্তেজনা ও উন্মেষ ছিল একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তির সূচনা, যা পুরনো রাজনৈতিক গণ্ডি ও সীমানাকে অতিক্রম করে।
গণ–অভ্যুত্থানের সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে যে জন–আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটে, তা ছিল নিছক প্রতিবাদের সীমা ছাড়িয়ে গভীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ। এই জনআন্দোলনের মূল ভাবনা ছিল দেশের সার্বভৌমত্ব, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের একটি অনন্য দিক ছিল এর বহুমাত্রিকতা। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন শ্রেণি, বয়স, পেশার মানুষ। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, শ্রমিক, নারী, সংখ্যালঘু, এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারীরা একযোগে দেশের পরিবর্তনের দাবিতে এগিয়ে আসেন। এ ধরনের ব্যাপক সামাজিক ঐক্য বাংলাদেশে বিরল।
জুলাই আন্দোলনে আরও একটি বিষয় দেখা যায়। দেশের রাজনৈতিক সংকট এবং আন্দোলনের চাপে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা প্রায়শই কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়ায়। এই আন্দোলনের সময়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। জুলাই আন্দোলনে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকাকে বিতর্বিকত অবস্থানে নিয়ে যায় তৎকালীন সরকার।

শুরুতে, পুলিশ বাহিনীকে সরকার আন্দোলন দমন করার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। কোটা সংস্কারের দাবিতে যখন ছাত্রসমাজ রাস্তায় নামে, তখন সরকার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে ভয় পেয়ে দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর এবং রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রছাত্রীদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস, এবং জলকামান ব্যবহার করা হয়।
বিশেষ করে রংপুরের ঘটনায় পুলিশি ভূমিকা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দেয়। সেখানে পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনা জাতীয় পর্যায়ে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে দেয়। পুলিশের এই নৃশংস পদক্ষেপ সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্রোধ এবং হতাশার জন্ম দেয়, যা আন্দোলনকে আরও বিস্ফোরক করে তোলে।

তবে আন্দোলনের সময় পুলিশ বাহিনীর ভেতরেও একটি দ্বিধা লক্ষ্য করা যায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খবর পাওয়া যায় যে, অনেক পুলিশ সদস্য জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। কিছু জায়গায় তাঁরা সরাসরি সরকারি নির্দেশ পালন থেকে বিরত থেকেছেন এবং আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
অন্যদিকে জুলাই অভ্যুত্থানকে দমাতে সরকার শেষ উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করে সেনাবাহিনীকে। তবে জুলাই আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে সেনাবাহিনী সরাসরি মাঠে নামেনি। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির সাথে সাথে শেখ হাসিনার সরকার সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার চিন্তা করতে থাকে। ছাত্র আন্দোলন এবং নাগরিকদের অংশগ্রহণ যখন ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন সরকার সেনাবাহিনীকে তৎপর করার উদ্যোগ নেয়।

সরকারের নির্দেশে সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয় এবং বিভিন্ন শহরে টহল দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। তবে মাঠ পর্যায়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল অপেক্ষাকৃত সংযত। এই পর্যায়ে তাদের কার্যকলাপ ছিল মূলত সহনশীল এবং পরোক্ষ।
আন্দোলনের মধ্যপর্যায় থেকে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হতে থাকে। 
তৎকালীন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নেয়। সেনাপ্রধান সরকারের পক্ষ থেকে যেকোনো ধরনের গুলি চালানোর নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি স্পষ্টভাবে জানান, সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের জনগণের সেবায় নিবেদিত এবং তারা কোনো ধরনের গণহত্যার অংশীদার হবে না।

শেখ হাসিনার সরকার যখন সেনাবাহিনীকে সরাসরি আন্দোলন দমনে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, তখন সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ অবস্থান আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই নিরপেক্ষতা শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ এবং শৃঙ্খলার প্রকাশ নয়, বরং এটি ছিল জনমতের প্রতি তাদের সম্মানের প্রতীক।
সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করে এবং আন্দোলনকারীদের মনোবল বৃদ্ধি করে। এর ফলে আন্দোলন আরও ব্যাপক এবং সংঘবদ্ধ রূপ নেয়।

জুলাই আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে সেনাবাহিনী একটি চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করে। শেখ হাসিনা সরকার যখন দেশব্যাপী সামরিক আইন জারি করার পরিকল্পনা করেছিল, তখন সেনাবাহিনী এটিকে সমর্থন জানায়নি। এমনকি, শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার আগে তাঁর সঙ্গে সেনাপ্রধানের একটি তিক্ত বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে সেনাপ্রধান স্পষ্টভাবে বলেন, সেনাবাহিনী আর কোনো দমনমূলক পদক্ষেপের অংশ হবে না। এই অবস্থানের ফলে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
সরকারের অভূতপূর্ব দমনপীড়ন সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ এবং সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততায় দেশের অভ্যুত্থান ছিলো একটি অভাবনীয় গণজাগরণের অধ্যায়। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময় জন–আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে উঠে আসে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবির সূচনা। আন্দোলনের সঙ্গেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, ও বিশেষজ্ঞ মিলে আলোচনা সভা, সেমিনার ও গণশুনানি করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন, নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার, বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মত বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসেন। এইসব দাবি শুধু রাজনৈতিক কথোপকথনের বিষয় ছিল না, বরং দেশের সার্বিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতিফলন।

গণ–অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, দেশের জনগণই রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক। ক্ষমতা ও শাসনদল যতই কঠোর হোক না কেন, জনগণের ঐক্য ও সচেতনতা তাদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারে। এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা করে, যেখানে সরকারী নিপীড়ন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক লড়াইকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করা হয়।

তবে এই উল্লাসের মাঝে রাজনীতিতে বিভাজনের আশঙ্কাও দেখা দেয়। গণ–অভ্যুত্থানের পরে কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং নতুন গঠিত সংগঠনগুলোর মধ্যে মতবিরোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আন্দোলনের ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই রাজনৈতিক বিভাজন দেশকে একটি দীর্ঘ অস্থিরতা ও অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দেয়। ঐক্য না থাকায় স্বৈরাচারী শক্তি পুনরায় ফিরে আসার একটি আশঙ্কা তৈরি হয়, যা গণ–অভ্যুত্থানের অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
সবকিছুর মাঝ দিয়েও অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে দেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর পুনর্গঠনের জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা, এবং পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির আধিপত্য এই প্রচেষ্টাকে অনেকাংশেই ব্যাহত করে। আন্দোলনের সূত্র ধরে প্রতিষ্ঠিত ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করলেও, পারস্পরিক আস্থার অভাবে তাদের কাজ সঠিক গতি পায়নি। ফলে দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হয়।

গণ–অভ্যুত্থান যে শুধু একটি মুহূর্তের ঘটনা নয়, বরং একটি চলমান প্রক্রিয়া, তা দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে স্পষ্ট। তারা বুঝতে পেরেছে যে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য ধৈর্য, ঐক্য এবং স্থায়ী উদ্যোগ প্রয়োজন। এই শিক্ষাটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন যে, স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল শাসকের ক্ষমতার বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ নয়, বরং একটি বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন যেখানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি থাকে।

এছাড়া, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও ঐক্য গড়ে তোলা রাষ্ট্রের সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। জনগণের আশা ও আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সকল পক্ষ একত্রিত হলে দেশ দ্রুত শান্তি ও উন্নয়নের পথে হাঁটবে। গণ–অভ্যুত্থানের শিক্ষাগুলো ভবিষ্যতে বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলন দেখিয়েছে যে, ক্ষমতা শুধু সরকারি পদে বসে রাখলেই যথেষ্ট নয়; বরং জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাটিও একান্ত জরুরী। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা প্রয়োজন এবং মানুষের মৌলিক অধিকার ও মুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া একান্ত জরুরি।

তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং তাদের রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের ওপর বিশেষ গুরুত্ব না দিলে দেশে তৈরি হতে পারে রাজনৈতিক স্থবিরতা। কারণ আগামী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তাদের হাতে, এবং তারা শুধু ঐতিহ্যের ধারক নয়, বরং পরিবর্তনের উৎস। প্রত্যাশা বলে, নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে দেশ একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক দিগন্তে প্রবেশ করবে, পুরোনো পথ নয় বরং যেখানে গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায় ও সাম্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, বরং একটি জনজাগরণের প্রতীক, যা দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে দেশের মানুষ একযোগে কাজ করে স্থায়ী পরিবর্তন এবং শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন করতে পারে।
গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ নিজেকে রাজ্যের প্রকৃত মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, এবং এই ঐতিহাসিক উপলব্ধি দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সেই অধ্যায় যেখানে সাধারণ মানুষ, তরুণ প্রজন্ম ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব একসঙ্গে মিলিত হয়ে দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। এই পরিবর্তনের পথ সহজ হবে না, কিন্তু জনগণের ঐক্য ও সংকল্পই তা সফল করবে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব







 সর্বশেষ সংবাদ

শ্রীলঙ্কায়ার মাটিতে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় বাংলাদেশের
হত্যার উদ্দেশ্যে মুজিববাদী সন্ত্রাসীরা জঙ্গি কায়দায় হামলা করেছে: নাহিদ
কালীগঞ্জে যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের স্মরণে কোরআন খতম, আলোচনা ও দোয়া
ঝিনাইগাতী থেকে যা কিছু দেখেছি সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিবন্ধী রফিকুলকে অটোরিক্সা প্রদান
২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ‘লংমার্চ টু গোপালগঞ্জ’: ইনকিলাব মঞ্চ
আরো খবর ⇒


 সর্বাধিক পঠিত

প্রতিদিন বাংলাদেশ এর নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সিফাতুল্লাহ কে সংবর্ধনা।
নালিতাবাড়ীতে নন্নী-পোড়াগাঁও মৈত্রী কলেজে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সংঘর্ষ,আটক ১৮
কালীগঞ্জে নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্রের উদ্বোধন
নালিতাবাড়ীতে সিএনজি চালকের মরদেহ উদ্ধার
সখীপুরে গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ, গ্রেপ্তার ২
প্রকাশক: এম এন এইচ বুলু
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মাহফুজুর রহমান রিমন  |   উপদেষ্টা সম্পাদক : রাজু আলীম  
বিএনএস সংবাদ প্রতিদিন লি. এর পক্ষে প্রকাশক এম এন এইচ বুলু কর্তৃক ৪০ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, বুলু ওশেন টাওয়ার, (১০তলা), বনানী, ঢাকা ১২১৩ থেকে প্রকাশিত ও শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
ফোন:০২৯৮২০০১৯-২০ ফ্যাক্স: ০২-৯৮২০০১৬ ই-মেইল: spnewsdesh@gmail.com