গোপালগঞ্জে বুধবারের (১৭ জুলাই) সহিংসতায় চারজন নিহত এবং ৪৫ জন পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকসহ প্রায় অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। পুলিশের তৈরি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গণমাধ্যমে এ প্রতিবেদন সরবরাহ করে।
পুলিশ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বুধবার (১৭ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার সময় উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিহত ৪ জনের মরদেহ পোস্ট মর্টেম করতে না দিয়ে জেলা হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়। এখনও পর্যন্ত যৌথবাহিনী ও পুলিশ নাশকতার ঘটনার সঙ্গে জড়িত ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গোপালগঞ্জ জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে এক হাজার ৫০৭ জন পুলিশ সদস্যসহ সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন আজ (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে বর্তমানে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রয়েছে।
পুলিশ প্রতিবেদনে ঘটনা প্রসঙ্গে বলা হয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে স্মরণ করতে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া মানুষের কথা শুনতে ১-৩০ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে মাসব্যাপী ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ১৬ জুলাই ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে বেলা ১১টায় গোপালগঞ্জ পৌর উন্মুক্ত মঞ্চে জাতীয় নাগরিক পার্টি এক জনসমাবেশ অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। এই সমাবেশে অংশ নেওয়ার জন্য আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টায় বরিশাল সার্কিট হাউজ এলাকা থেকে দলের কেন্দ্রীয় নেতা আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, দক্ষিণ অঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুলাহ, উত্তর অঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব শামান্তা শারমিন, তাসনিম জারা, সিনিয়র মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, আরিফুল দাড়িয়াসহ কেন্দ্রীয় নেতারা রওনা দেন। সমাবেশের নিরাপত্তা জন্য সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন তৎপর থাকে। সকাল সাড়ে ৯টায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের একটি সন্ত্রাসী দল গোপালগঞ্জ সদর থানার উলপুরে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলাসহ গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এসময় একজন পুলিশ পরিদর্শকসহ ৩ জন পুলিশ সদস্য আহত হন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সকাল ১১টার সময় গোপালগঞ্জ সদর থানার কংশুর বাসস্ট্যান্ডে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌর শাখার যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. ওমর ফারুক খান রিপনের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক সড়কে গাছ ফেলে এবং কাঠ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় গোপালগঞ্জ ইএনও’র গাড়ি সেখানে গেলে গাড়ি ভাঙচুরসহ সড়ক অবরোধ করে রাখে।
এরপর সকাল সাড়ে ১১টার সময় কোটালীপাড়া থানার অবদার হাট এলাকায় কোটালীপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম দারিয়ার নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল করে কোটালীপাড়া-পয়সার হাট সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে ২৮০০- ৩০০০ নেতাকর্মী রাস্তা অবরোধ করে রাখে। সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে গোপালগঞ্জ সদর থানার কাঠি বাজার এলাকায় গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌরসভার মামুনের নেতৃত্বে ২০০-৩০০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা গোপালগঞ্জ পৌরপার্ক সভাস্থলে পৌঁছানোর আগে দুপুর আনুমানিক ১টা ৪০ মিনিটে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ৫০-৬০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল ককটেল বিস্ফোরণসহ ঢাল, দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মঞ্চে আক্রমণ করে। তারা মঞ্চের ব্যানার এবং চেয়ার ভাঙচুর করে। দুপুর ২টায় নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা মঞ্চে ওঠেন। ইতোমধ্যে দুপুর সোয়া ২টায় গোপালগঞ্জ সদর থানার সাতপাড় বাজার এলাকায় দুর্বৃত্তরা ২টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ২টি মোটরসাইকেলে অগ্নি সংযোগ করে। উচ্ছৃঙ্খল জনগণ রাস্তায় গাছের গুড়ি ফেলে ব্যারিকেড দেয় এবং বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ করে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দুপুর পৌনে ৩টায় পদযাত্রা সভা সমাপ্ত করে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা সভাস্থল ত্যাগ করেন। এই পদযাত্রা সভায় আনুমানিক ২০০ জন লোক উপস্থিত ছিল। সভা শেষে তাদের গাড়ি বহর পরবর্তী পদযাত্রার সভাস্থল মাদারীপুরের উদ্দেশে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রহরায় রওনা দিলে গোপালগঞ্জ পৌরসভার লঞ্চ ঘাটে আওয়ামী লীগ ও এর নিষিদ্ধ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আনুমানিক ৩টায় গাড়ি বহর আটকে দেয়। সেনাবাহিনী ও পুলিশ উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কোনও কথা না শুনে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীসহ এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ করে। এছাড়া নাশকতাকারীরা গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারসহ অন্যান্য সরকারি স্থাপনায় হামলা করে। এসময় সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। এ ঘটনায় প্রায় ৪৫ জন পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকসহ প্রায় অর্ধশতাধিক লোকজন আহত হন বলে জানা যায়। নাশকতাকারীদের আক্রমণের ফলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ এনসিপি নেতাকর্মীদের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিরাপদে নিয়ে আসে। পরবর্তী সময়ে বিকাল ৪টা ৫৮ মিনিটে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে যৌথ বাহিনীর সহায়তায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা গাড়িতে করে বাগেরহাট হয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে চলে যান।