বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫ ২ শ্রাবণ ১৪৩২
 
শিরোনাম:


মৃত মানুষের চেয়ে, জীবিত মানুষের টাকার বেশী প্রয়োজন
দানবাক্স মাজারে নয়, হাসপাতালে থাকা দরকার
মো. আফতাব আনোয়ার
প্রকাশ: শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০২৫, ৪:৪৯ PM

কানাডা প্রবাসী ফেসবুক ফ্রেন্ড জনাব কামাল  উদ্দিন কর্তৃক প্রেরিত ‘দানবাক্স মাজারে নয়, হাসপাতালে থাকা দরকার। মৃত মানুষের চেয়ে, জীবিত মানুষের টাকার বেশী প্রয়োজন।’ এই লেখা সম্বলিত একটি লিংক পাই। এই মূল্যবান কথাগুলোর প্রেক্ষিতে উপস্থাপিত হয়েছে আমার নিম্নেবর্ণিত কথাগুলো। আমি দীর্ঘ ২৫ বছর শাহ পরাণ (রঃ)  মাজার সংলগ্ন এলাকা খাদিমনগর, সিলেটে ছিলাম।

মাজার সম্পর্কে আমার ধারণা ছিলো অস্পষ্ট। জনশ্রুতি আছে হযরত শাহপরাণ  (রঃ)  মাজারের উপর দিয়ে পাখি উড়তে পারতো না, কোনো মানুষ  অপবিত্র অবস্থায় মাজার প্রাঙ্গণে আসতে পারতো না, মাজারে এসে কেউ অপকর্ম করলে তাৎক্ষণিক ক্ষতি হতো, চিত্রনায়ক রহমান মাজার এলাকার রাস্তা দিয়ে আদবের সহিত না যাওয়ায় পা হারান। এ গুলি সবই বিশ্বাস করতাম অতিভক্তি বা ভয় থেকে। ১৯৮৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আর্টিস্ট পদবিতে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বিআরডিটিআই), খাদিমনগর, সিলেট- ৩১০৩ এ যোগদান করি। বিআরডিটিআই থেকে হাঁটার দুরত্বে শাহ পরাণ (রঃ) এর মাজার। ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর ও ওরস শরীফে যেতাম নামাজ পড়তে ও কবর যিয়ারত করতে। তাছাড়া পাঁচ মাইল দুরত্বে হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজার। সেখানেও একাকী,  মাঝে মাঝে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে  কিংবা প্রশিক্ষণার্থীদের গাইড হিসেবে প্রায়শই যেতে হতো।

দীর্ঘদিন মাজার এলাকায় থাকা ও একাধিকবার প্রশিক্ষণার্থীদের গাইড হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুবাদে  অস্পষ্ট বিষয়গুলো আমার নিকট ক্রমশই স্পষ্ট হতে থাকে এই ধরনের বিশ্বাসগুলো একটি সমাজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলোকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করা যায় না।

প্রথমে বুঝতে পারি নাই, মাজার কাদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। পরে বুঝলাম, দেখলাম যে সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাগণের মধ্যে বংশপরম্পরায় খাদেমগণ কর্তৃক মাজার পরিচালিত হয়। এখানে এ বিষয়ে একটি ঘটনা তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করছিঃ- ঘটনাটি ১৯৮৬ সালের। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিব মহোদয়ের বিআরডিটিআই পরিদর্শনে আগমন উপলক্ষ্যে সারারাত জেগে বিআরডিটিআই এর প্রশিক্ষণ অগ্রগতি সহ সার্বিক কর্মকান্ড সম্বলিত প্রতিবেদন তৈরীতে ব্যস্ত ছিলাম আমরা সবাই ।

পরের দিন সচিব মহোদয়ের উপস্থিতিতে পরিচালক মহোদয়ের কক্ষে আমি যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম আলখাল্লা পড়া স্মার্ট একজন যুবক করিডোরে দাঁড়িয়ে আছেন। পরিচয় জানলাম তিনি হযরত শাহ পরাণ (রঃ)  মাজারের খাদেম। আসার কারণ হিসেবে জানলাম যে, সচিব মহোদয়কে মাজার পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া। আলাপে আরও জানা গেলো যে, উনি তার ব্যক্তিগত গাড়িটির তেলের ট্যাঙ্ক পেট্রল দিয়ে ভরে এনেছে। কারণ সচিব মহোদয় তার গাড়িতে চড়ে নাকি মাজার পরিদর্শনশেষে সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলো উপভোগ করবেন।

মনে প্রশ্ন জাগে অনেক:-  বিআরডিটিআই পরিদর্শনে এসে মাজারের গাড়িতে কেনো দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ। পরে জানতে পারলাম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনেই মাজারের সকল সংস্কার  ও রক্ষণাবেক্ষনের কাজগুলো পরিচালিত হয়। তারমানে সচিব মহোদয় মাজারগুলোরও অভিভাবক। তাই প্যান্ট-শার্টের আধুনিক ড্রেসের পরিবর্তে এই আলখাল্লা ড্রেস! সাময়িক সময়ের এ রকম কর্মকান্ড নিয়ে ভাবতেই অবাক লাগে।  বাংলাদেশে মাজার সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কোনো একক মন্ত্রণালয়ের উপর নির্ভর করে না। সাধারণত, এটি নির্ভর করে মাজারটির অবস্থান, ধর্মীয় গুরুত্ব এবং এর সম্পত্তির মালিকানা কার, এগুলোর উপর। যে সব মন্ত্রণালয় বা সংস্থা জড়িত হতে পারে: সেগুলো হলোঃ- ধর্ম মন্ত্রণালয়, পুরাতত্ত্ব অধিদপ্তর,  
স্থানীয় সরকার, ওয়াকফ বোর্ড, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলি যদি ভালোভাবে যাচাই-বাছাইকরতঃ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজগুলো করতেন, তাহলে  মাজারে এতো অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নিম্নোক্ত অনৈতিক কাজগুলো হতো না।
যেমন- ওরস শরীফে লাল-সালু কাপড় পরিহিত লম্বা চুলের লোকজন, নাচানাচি, গাঁজা-ভাং খেয়ে ধ্যান-মগ্ন থাকা। যা বিদআতের পর্যায়ে পড়ে।

এ ব্যাপারে আমি তাদের একজন ভক্তকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আপনারা নামাজ না পড়ে অপবিত্র শরীরে নেশা খেয়ে উচ্চস্বরে গান গাচ্ছেন, এটা কি আউলিয়াগণ কিংবা ধর্ম সমর্থন করেন? এর উত্তরে সেই ভক্ত বললেন যে আমরা বংশপরম্পরায় এভাবেই আউলিয়াগণের আশীর্বাদ গ্রহন করে আসছি। আমাদের মতো এতো ধ্যান-মগ্ন অবস্থায় কেউ আউলিয়াগনের  কাছাকাছি আসতে পারেন নাই। এর উত্তরে আমি আর কী বলবো? যারা বলার তারাইতো কিছু বলছে না। মাজার প্রাঙ্গণে  ইসলামি জ্ঞানে সমৃদ্ধ ইমাম সাহেব আছেন। তাঁর উপস্থিতিতে এমন গর্হিত কাজগুলি তারা করে যাচ্ছেন। মাজার কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ খাদেমগণ সহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মন্ত্রণালয়ের  উর্ধতন কর্তৃপক্ষও জানেন যে তারা কত বড় গর্হিত কাজগুলি পবিত্র মাজার প্রাঙ্গনে করে যাচ্ছেন। কেউ কিছু বলছে না।  এর একমাত্র কারণ কি হতে পারে? উত্তর একটাই ব্যবসা। তা না হলে  তাদের বাৎসরিক ব্যবসা যে হাতছাড়া হয়ে যাবে।

মোমবাতি, আগরবাতি, গোলাপজল, হালুয়া, নকুলদানা, সূতা ও টাকা-পয়সা যখনই আপনি মাজার প্রতিনিধিকে দিবেন, তা একটি নির্দিষ্ট স্থানে গ্রহণ করা হলেও, পরবর্তী সময়ে তা আবার সেই দোকানেই চলে যাবে, যেখান থেকে আপনি কিনেছেন। সেই দোকানি আবার অন্য ক্রেতার কাছে বিক্রি করবে। কি ভয়াবহ ব্যাপারটি, তাই না! মানতের খাসি, ছাগল, হাঁস, মুরগি-মোরগ সহ যা'ই দান করেন না কেনো, তা খাদেম গোষ্ঠীর মনোনীত ব্যক্তিবর্গ দ্বারা তাদের  বাসার রান্নাঘরে অথবা বাজারে চলে যাবে।

টাকা-পয়সা যা সিন্দুকে আসে তা খাদেম পরিবারের  সকল প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় নির্বাহ হয়ে থাকে। আমরা যারা অতিভক্তি বা ভয় থেকে এ কাজগুলো করে থাকি তারা মাজার প্রাঙ্গনে মৃত আউলিয়ার জন্য দোয়া করি এবং তাঁদের মতো উন্নত সহি-শুদ্ধ ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী করে যেনো আমাদেরকে গড়ে তুলতে পারি, এজন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিকট কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি। এর বাইরে অহেতুক টাকা-পয়সা, হালুয়া, আগরবাতি, গোলাপজল, নকুলদানা ইত্যাদি  মাজারে  না দিয়ে অন্য কোথাও দেই,  যেখানে দিলে  আমরা মরে যাওয়ার পর, আমলনামা বন্ধ হলেও সদকায়ে জারিয়া হিসেবে আমলনামায় জমা হবে।

উল্লিখিত বর্ণনা থেকে যা জানলাম তাতে আমাদের ধর্মীয় জ্ঞানের অপ্রতুলতার কারণে আমরা মাজারে যে উপঢৌকনগুলো দেই তা এখন থেকে না দিয়ে যদি সেই উপঢৌকনগুলো-গরীব  মানুষগুলোর কল্যাণে ব্যবহার করি তাহলে আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে সাচ্ছন্দ্য দান করবেন। যে মূল্যবান কথাগুলো দিয়ে শুরু করেছিলাম "দানবাক্স মাজারে নয়, হাসপাতালে থাকা দরকার। মৃত মানুষের চেয়ে, জীবিত মানুষের টাকার বেশী প্রয়োজন।" এই লেখাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে চাইলে অবশ্যই সরকারি ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি ও সিদ্ধান্ত একান্তভাবে  প্রয়োজন।

তাই সরকার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে যদি সকল রোগী থেকে হাসপাতালের প্রবেশ দ্বারে "গরীব রোগীদের সাহায্যার্থে মুক্ত হস্তে দান করুন" শিরোনামের বক্স অথবা রোগী ভর্তি বা ডিসচার্জের সময় গরীব রোগীদের সাহায্যার্থে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ধার্য্য করে যদি আদায়ের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে দুনিয়া ও আখিরাতে অশেষ সওয়াব হাসিল হবে।
পরিশেষে আবারও বলবো আর বিদআাত নয় আমাদের কষ্টের টাকা মাজারে না দিয়ে প্রকৃতই যাদের প্রয়োজন তাদেরকে দেই। সবার মাঝে মূল্যবান কথাগুলোকে ছড়িয়ে দেই ‘দানবাক্স মাজারে নয়, হাসপাতালে থাকা দরকার। মৃত মানুষের চেয়ে, জীবিত মানুষের টাকার বেশী প্রয়োজন।’

লেখক:  কর্মকর্তা (অবঃ), বিআরডিবি, পল্লী ভবন, কাওরানবাজার, ঢাকা।
anwaraftab611@gmail.com







 সর্বশেষ সংবাদ

শ্রীলঙ্কায়ার মাটিতে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় বাংলাদেশের
হত্যার উদ্দেশ্যে মুজিববাদী সন্ত্রাসীরা জঙ্গি কায়দায় হামলা করেছে: নাহিদ
কালীগঞ্জে যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের স্মরণে কোরআন খতম, আলোচনা ও দোয়া
ঝিনাইগাতী থেকে যা কিছু দেখেছি সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিবন্ধী রফিকুলকে অটোরিক্সা প্রদান
২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ‘লংমার্চ টু গোপালগঞ্জ’: ইনকিলাব মঞ্চ
আরো খবর ⇒


 সর্বাধিক পঠিত

প্রতিদিন বাংলাদেশ এর নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সিফাতুল্লাহ কে সংবর্ধনা।
নালিতাবাড়ীতে নন্নী-পোড়াগাঁও মৈত্রী কলেজে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সংঘর্ষ,আটক ১৮
কালীগঞ্জে নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্রের উদ্বোধন
নালিতাবাড়ীতে সিএনজি চালকের মরদেহ উদ্ধার
সখীপুরে গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ, গ্রেপ্তার ২
প্রকাশক: এম এন এইচ বুলু
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মাহফুজুর রহমান রিমন  |   উপদেষ্টা সম্পাদক : রাজু আলীম  
বিএনএস সংবাদ প্রতিদিন লি. এর পক্ষে প্রকাশক এম এন এইচ বুলু কর্তৃক ৪০ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, বুলু ওশেন টাওয়ার, (১০তলা), বনানী, ঢাকা ১২১৩ থেকে প্রকাশিত ও শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
ফোন:০২৯৮২০০১৯-২০ ফ্যাক্স: ০২-৯৮২০০১৬ ই-মেইল: spnewsdesh@gmail.com