প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০২৫, ৬:৪৭ PM
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ এই ছটি বছর শিল্পাচার্যের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তদানীন্তন ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের সামগ্রিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক ও নৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বিশ্বযুদ্ধ মানবতা ও শুভবুদ্ধির সমাধি রচনা করে। ১৯৪২-৪৩ সালে শুরু হয় মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ (মন্বন্তর)। বাংলার চাল অন্য স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়। গ্রাম-বাংলার হাজার হাজার কঙ্কালসার মানুষ মহানগরীতে ভীড় করতে লাগলো দু’মুঠো অন্নের আশায়। শুরু হলো মৃত্যু। অদৃষ্টপূর্ব মৃত্যু, ভয়াল ভীষণ কুৎসিত মৃত্যু আর মনুষ্যত্বের অপমান। বাংলার মানুষের এই ভয়াবহ দৃশ্য শিল্পীকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। রং তুলি দিয়ে শুরু হয় জয়নুলের দুর্ভিক্ষের স্কেচ। স্বল্প সংখ্যক রেখা ও আঁচড় দিয়ে যে জগৎ বিখ্যাত হওয়া যায়, শিল্পাচার্য তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। বিশ্ববাসী দুর্ভিক্ষের ছবি দেখে আঁতকে উঠেন, চমকে উঠেন। কোলকাতার বিভিন্ন পত্র পত্রিকা বিশেষ করে ‘পিপলস্ ওয়ার’ ও ‘জনযুদ্ধ’ নামের দু’টি সাপ্তাহিকীতে এই ছবি ছাপা হয়। দুর্ভিক্ষের এই ছবির জন্য দেশে বিদেশে চিত্র সমালোচকদের হƒদয়ে করে নিলেন এক স্থায়ী আসন। কোলকাতায় পনেরো বছরের জীবন হলো জয়নুল আবেদিন স্যারের নির্মাণকাল। জীবনের শ্রেষ্ঠ তিনটি ঘটনা কোলকাতা অবস্থান কালেই ঘটে যেমন- কোলকাতা আর্ট কলেজ থেকে ১৯৩৮ সালে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে ডিগ্রী অর্জন। ১৯৪৩ এ দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে স্বীকৃতি লাভ এবং বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিঃসন্দেহে শিল্পাচার্যের পরবর্তী জীবনের পথ নির্দেশ। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের আর্ট কলেজে পড়াকালীন সময়ে বনভোজন-১৯৭৫ সালে ঈসা খাঁ এর রাজধানী সোনার গাঁ, নারায়ণগঞ্জে যেদিন যাই সেদিন প্রত্যুষে জয়নুল স্যার আর্ট কলেজ করিডোরে চেয়ার পেতে বসেছিলেন। আমাদের সঙ্গে বনভোজনে যাওয়ার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করেছিলাম, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন নি।
সেদিন স্যার আবেগপ্রবণ হয়ে অনেক কথাই আমাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। বিশেষ করে মেয়েদেরকে সামনে রেখে আমাদেরকে বলেছিলেন, ‘মেয়েরা আমাদের সমাজে ভবিষ্যতে কতটুকু এগুতে পারবে জানি না, তবে তোমাদের উপর আমি শতভাগ আস্থা রেখে বলছি যে একদিন চারু ও কারু শিল্পে, এ দেশে তোমাদের দ্বারা অকল্পনীয় বিপ্লব ঘটবে, তাই কঠোর পরিশ্রম করে যাও, সফলতা আসবেই’।
স্যারের ভবিষ্যৎ বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে। দেশের প্রতিটি মাধ্যমে এখন চোখধাঁধানো শিল্পের ছোঁয়া, যা ৭০ দশকেও ছিলো পুরোপুরি অনুপস্থিত। বনভোজনের বাস যখন আর্ট কলেজ থেকে শাহবাগ মোড়ের সেই ঐতিহ্যবাহী ‘ভি’ আকৃতির ফোয়ারা (যা বর্তমানে নেই) অতিক্রম করছিলাম, ঠিক তখন আমাদের পেছনের বাস থেকে তাগিদ আসলো যে জরুরী প্রয়োজনে জয়নুল স্যার আমাদের ডেকেছেন। বাস ঘুরিয়ে আমরা আবার কলেজে গেলাম। দেখলাম স্যারের বিমর্ষ চেহারায় আলোক রশ্মি! আমাদের দেখে উৎফুল্ল চিত্তে নিজ সন্তানের মতো কাছে টেনে আমাদের নাম সম্বোধন করে বললো, ‘তোমরা ঈসা খাঁ’র রাজপ্রাসাদে ভুলেও সিড়ি বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করবে না। চকচকে শ্বেত পাথর দেখে মনে হতে পারে খুবই শক্ত-মজবুত নতুন ভবন, কিন্তু বাস্তবে কিন্তু খুবই দুর্বল। তাই বাসের সকল বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্যদের খুবই গুরুত্ব সহকারে আমার এ নির্দেশটি পালন করবার জন্য বলবে।’ এ কথাগুলো বলে পুনরায় আদরের পরশ বুলিয়ে আমাদেরকে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন। এ সকল স্মৃতি মনে করে আজকের এ দিনে নিজেকে বড়ই অসহায় ও দুর্বল মনে হয়। কি এক মহিরুহ-কে আমরা হারিয়েছি। স্যার ছিলেন শান্ত স্বভাবের। হৈ হুল্লোড় ও গোলমালের মধ্যে তিনি কখনও যেতেন না। বাড়ির একটি কামরা তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিলো। সেখানেই তিনি আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে ছবি আঁকতেন।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা শিক্ষাকে তিনি চালক হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন নি। বাল্যকাল থেকেই প্রকৃতিই ছিলো তাঁর প্রকৃত গুরু। বার্ষিক পরীক্ষায় হেডমাস্টারকে আরো বেশী আন্দোলিত করে। বার্ষিক পরীক্ষায় ইংরেজি পত্রে একটি কবিতা মুখস্থ না লিখে তিনি উত্তর পত্রে কবিতাটির মূল বক্তব্যের চিত্রায়ন করেন। এ ঘটনায় অনেক শিক্ষকের হাসির খোরাক হলেও স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকের মনে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। এই আগ্রহ উদ্দিপনাই জয়নুলকে কোলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হতে সাহায্য করে। ১৯৭২ এর মাঝামাঝি সময় থেকে ১৯৭৫ এর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত শিল্পাচার্য অসুস্থ বোধ করতেন বার্ধক্যজনিত কারণে। ১৯৭৫ সালের শেষে শিল্পাচার্য পুনরায় অসুস্থ হলে চিকিৎসকগণ শিল্পীর ব্যাধিকে দুরারোগ্য ক্যান্সার মনে করে লন্ডন পাঠাবার পরামর্শ দেন। লন্ডনের চিকিৎসকগণ তাঁর নিরাময়ে খুব একটা উৎসাহ প্রদর্শন করেননি। ১৯৭৬ এর ৭ মে শিল্পাচার্যকে বেশ অসুস্থ অবস্থায় পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখনই শিল্পীর ‘দীপের আলো’ তিলে তিলে নিভে আসতে লাগলো। এখানে উল্লেখ্য যে- আমরা বেশ কয়েকজন হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। কথা বলার সুযোাগ হয়নি। শুধু ইজেলে থাকা তাঁর আঁকা শেষ ছবি ‘দুই মুখ’ সহ স্যারের কষ্ট সহ্য করা জীবন্ত মুখটি শেষবার দেখে চলে আসতে হয়েছিলো। এ দেখাই যে শেষ দেখা, আমরা বেশ কয়েকজন হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। কথা বলার সুযোাগ হয়নি। শুধু ইজেলে থাকা তাঁর আঁকা শেষ ছবি ‘দুই মুখ’ সহ স্যারের কষ্ট সহ্য করা জীবন্ত মুখটি শেষবার দেখে চলে আসতে হয়েছিলো। এ দেখাই যে শেষ দেখা, ভাবতে পারিনি। ২৮ মে ১৯৭৬ এ ‘এক কিংবদন্তি’র বিদায় হিসেবে নিস্প্রাণ দেহে তাঁকে দেখতে হলো। আমি তাঁর প্রয়াণ দিবসে জানাই গভীর বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: প্রাক্তন ছাত্র, (শিক্ষাবর্ষ ১৯৭৪ হতে ১৯৭৯) এবং কর্মকর্তা (অবঃ), বিআরডিবি, পল্লী ভবন, কাওরানবাজার, ঢাকা।