
বিশ্ব শিক্ষক দিবস ছিল ৫ অক্টোবর। শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতি বছর এই দিনে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিনটি অত্যন্ত গৌরব ও মর্যাদার সাথে পালিত হয়। শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কিত ইউনেস্কো-আইএলও’র সুপারিশমালা গৃহীত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সাল থেকে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এই বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো "কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও শিক্ষাঃ স্বয়ংক্রিয়তার যুগে মানবিক দক্ষতা সংরক্ষণ"
শিক্ষকদের প্রতি সম্মান জানানোর এই দিনটি পৃথিবীর সকল দেশের শিক্ষক সমাজের নিকট অত্যন্ত গৌরবের।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, আর সেই মেরুদণ্ডের স্রষ্টা হলেন আমাদের সম্মানিত শিক্ষকগণ। পৃথিবীতে যতগুলো সম্মানজনক পেশা আছে, তার মধ্যে শিক্ষকতা পেশা সর্বোচ্চ সম্মানিত। মানুষের মধ্যে যারা কৃতজ্ঞ শ্রেণীর, তারা সার্বিকভাবে না হলেও ব্যক্তিগতভাবে কোনো না কোনো শিক্ষকের কাছে ঋণী এবং বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সেই অভিব্যক্তিও ফুটে ওঠে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হিসেবে স্বীকৃত।
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমার শৈশবের স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠছে। ১৯৬৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আমি আরমানিটোলা মাঠের কাছে অবস্থিত হাম্মাদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। প্রধান শিক্ষক শ্রদ্ধেয় ফজলুর রহমান স্যারের কক্ষে ভর্তি হতে গিয়ে তাঁর জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়েছিলাম। তিনি আমাকে 'দোয়া মাছুরা' মুখস্থ আছে কিনা জানতে চাইলেন। যখন মুখস্থ বলে শোনালাম, তিনি খুশি হয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। তাঁর সেই ভাবগম্ভীর কথোপকথন এবং সরলতা আজও আমার হৃদয়ে উজ্জ্বল। সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ আবদুল গফুর স্যারের বাংলা পড়ানোর ঢং ছিল অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। অষ্টম শ্রেণীর চকবোর্ডে আবুল কালাম আজাদ স্যারের লেখা আফ্রিকান প্রবাদ "Time once lost, is lost forever." আজও আমার চোখে দৃশ্যমান। ধর্ম স্যার মিন্নত আলী আমাদের সঠিকভাবে নামাজ পড়া শিখিয়েছেন, ইংরেজি স্যার মনিরুল ইসলাম প্রতিদিন পাঁচটি করে ইংরেজি শব্দ মুখস্থ করতে বলেছিলেন, যা ভবিষ্যতে সাবলীলভাবে কথা বলতে ও লিখতে সাহায্য করবে। গণিত স্যার শাহজাহান, যাঁর জটিল সূত্রগুলোও মনে হতো জাদুর মতো সহজ। বিশেষ করে তাঁর কম্পাস ছাড়া নিখুঁত বৃত্ত আঁকা আমাকে একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। খেলাধুলার স্যার সেকান্দার আলী শুধু খেলাই শেখাতেন না, শেখাতেন হার না মানার মানসিকতা। গ্রন্থাগারিক মোঃ শফিক স্যার তাঁর বুক শেল্ফে থাকা নজরুল, রবীন্দ্র, শেক্সপিয়ার সহ বহু কথাশিল্পীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

আমার প্রথম ক্লাসের অভিজ্ঞতা ছিল মধুর এবং তিক্ততার এক অদ্ভুত মিশেল। বিজ্ঞান ক্লাসে আবুল কালাম আজাদ স্যার হাতি, ঘোড়া, বাঘ, জেব্রার ছবি আঁকতে দিলেন। পরদিন খাতা জমা দিলে স্যার বিশ্বাস করলেন না যে আমি নিজে এঁকেছি। সেদিন বেতের আঘাত সহ্য করার পর যখন তিনি আমাকে চকবোর্ডে আঁকতে বললেন, আমি সহজেই একে দেখালাম। সেই মুহূর্তে স্যারসহ ক্লাসের সবার বিস্ময়ভরা চাহনি আজও মনে পড়ে।
হাম্মাদিয়া হাই স্কুলের সেই স্বর্ণালী দিনগুলো আজও ভুলতে পারি না। প্রতিটি ক্লাস, টিফিন পিরিয়ড, দপ্তরির নির্দিষ্ট সময়ে ঘন্টা পেটানোর শব্দ, ক্লাস শেষে হৈ-হুল্লোড় করে বিদ্যালয় ত্যাগ - সবকিছু যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেই কিশোর আমি আজ প্রবীণ, কিন্তু সেই শিক্ষকদের দেওয়া শিক্ষা আজও আমার চলার পথের পাথেয়। তাঁদের আন্তরিকতাপূর্ণ শিক্ষালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই আজ আমরা জীবনে প্রতিষ্ঠিত। হাম্মাদিয়া থেকে বেরিয়ে আসা অনেক মেধাবী ছাত্র আজ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে দেশ-বিদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, আর এর পেছনে আমাদের শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরা আমাদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করেছেন। তাঁদের ঋণ কোনোদিন ভুলবার বা শোধ করবার নয়।
আজকাল আমরা গুরুজনদের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছি। নিজেদেরকে চার দেয়ালের মাঝে গুটিয়ে রাখতে গিয়ে আপনজনদের মাঝে সৃষ্টি করেছি সম্পর্কচ্ছেদের এক বিরাট দেয়াল। এমন সময়ে আমার এক প্রিয় ছাত্রী আন্নামা চৌধুরী'র শিক্ষকদের প্রতি গভীর ভালোবাসা আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তার লেখায় শিক্ষকদের প্রতি যে হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে, তা বিরল। সে লিখেছে, "শিক্ষক অত্যন্ত মহৎ একটি শব্দ। প্রত্যেকের জীবনে কয়েকজন শিক্ষক থাকেন, যাদের স্নেহ, মমতা, শাসন আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে থাকে।" আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে, চমৎকার শিক্ষকদের পেয়েছি।" তার এই অনুভূতিতে ফুটে ওঠে শিক্ষকদের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
আন্নামা তার শৈশবের শিক্ষকদের স্মৃতিচারণ করে লিখেছে, "একদম যখন ছোট তখন পড়া শুরু হয় সিলেট এম.সি কলেজ শিশু বিদ্যালয়ে। সেখানে দিলারা নজরুল ম্যাডাম, দিলরুবা জাকিয়া ম্যাডাম, নাইম ফাতেমা ম্যাডাম, সুপ্তি ম্যাডামের ভালোবাসা এখনও মনে পড়ে। স্কুল ছেড়েছি ২০০৪ সালে, কিন্তু ম্যাডামরা দেখলে এখনও বুকে টেনে নেন। অগ্রগামী তে ভর্তি হই তৃতীয় শ্রেণিতে, বের হই এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে। সেখানে প্রিয় শিক্ষকদের তালিকা অনেক লম্বা। প্রথমদিকে নমিতা ম্যাডামের ক্লাস ছিল খুব সুন্দর, তিনি আদর করে পড়াতেন। কোহেলী ম্যাডামের দুর্দান্ত বাংলা ক্লাস ছিল, মন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। রোকসানা ম্যাডাম আর শাহানা ম্যাডামকে সবাই ভয় পেতো, কিন্তু কেন জানি আমার খুব পছন্দের ছিলেন। তাঁরা দুজনেই অত্যন্ত স্নেহ করতেন। শানু ম্যাডাম, আভা ম্যাডাম, দেবশ্রী ম্যাডাম সবাই অনেক আদর করেছেন। মরিয়ম জামিলা ম্যাডাম খুব সুন্দর করে সবার সাথে কথা বলতেন, তাঁর সুন্দর আচরণে সবাই মুগ্ধ থাকতো। অন্য শাখার হলেও রোজি ম্যাডামের চমৎকার ভয়েস আর মায়াভরা কণ্ঠ ছিল। নাজমা ম্যাডাম সব সময়ই বলতেন আমরা উনার মেয়ে, মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগেই থাকতো। প্রধান শিক্ষক বাবলী ম্যাডাম কখনো অহংকার করেন নি, অত্যন্ত সুন্দর করে কথা বলতেন।
'সোপানে' আর্ট আর আবৃত্তি শেখার সময় আফতাব আনোয়ার স্যারের সান্নিধ্য পাই। তিনি এতো সুন্দর করে বোঝাতেন, আর কথা বলতেন যে অপলক চেয়ে থাকতাম। শাহীন স্যার, মালেক স্যার, পার্থ স্যার, সুদর্শন স্যার, অপু স্যার, টিপু স্যার প্রত্যেকে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। খুব মনে পড়ছে আমাদের পঙ্কজ স্যারের কথা, যিনি এতো আদর করতেন, কিন্তু অকালেই চলে গেলেন।
রাসেল মামা, যিনি আমাদের বাসায় এসে পড়াতেন। সাত বছর পড়িয়েছেন। কত যে দুষ্টুমি করেছি, কিন্তু সব সময় আদর করে পড়াতেন। মোঃ মাহমুদুর রহমান স্যারকে আমরা 'টাইম মেশিন' ডাকতাম। একদম সময় মতো আসতেন। তাঁর পড়া না শিখলে ভয়ে কুঁকড়ে থাকতাম, কিন্তু স্যার আমাদের প্রচণ্ড ভালবাসতেন। আতিক স্যার চুপচাপ ভদ্র মানুষ, অংক পড়াতেন। না পারলে বলতেন, 'কাল বেত নিয়ে আসবো', সে বেত আমরা চোখে দেখিনি। আমাদের হুজুর, নিজাম সাহেবকে আমরা দুই বোন প্রচণ্ড জ্বালিয়েছি, কখনো বকেননি। মরিয়ম জাহান মুন্নি মিসকে এতোটা পছন্দ করতাম যে তিনি অন্য সেকশনে গেলে সেকশন বদল করে ফেলেছিলাম। সাবিনা ইয়েসমিন স্মৃতি মিস যেমন সুন্দরী ছিলেন, তেমন তাঁর ব্যবহারও ছিল অত্যন্ত সুন্দর ও অমায়িক।"
আন্নামা আরও লিখেছে, "অনার্সে এসে পেয়েছি মোঃ গোলাম মওলা পিয়াস স্যারকে। স্যার না থাকলে ইংরেজীর এতো জটিল বিষয় কখনো মাথায় ঢুকতো না। স্যারের অনুপ্রেরণামূলক কথায় প্রতিদিন অনুপ্রাণিত হয়ে স্বপ্ন দেখি। শিপন স্যার, তারেক স্যার, শফিউল আলম স্যার, একেকজন দুর্দান্ত টিচার। তাঁদের কথা শুনলেই মন ভরে যায়। ডিপার্টমেন্ট ছাড়া কলেজের অনেক শিক্ষক আছেন যারা আমার অত্যন্ত প্রিয়, যেমন ক্যাম্পাসের জননী শামীমা ম্যাম, যার চমৎকার ব্যবহার সবাইকে মুগ্ধ করে। পান্না রানী রায় ম্যাডামের ক্লাস করে প্রচণ্ড ভালো লেগেছিল, তিনি সব সময় পরিপাটি হয়ে থাকেন। শাহনাজ শিলা ম্যামকে 'সুহাসিনী' বলা যায়। সাহেদা ম্যামকে দেখলেই কেমন একজন অভিভাবকের ছায়া পাওয়া যায়। রিয়াজ স্যার অত্যন্ত হাসি মুখের সুন্দর মনের একজন মানুষ। খালেক স্যার, নজরুল স্যার, ফৌজিয়া ম্যাম না গেলে স্কাউটের অনুষ্ঠানে বড় শূন্য শূন্য লাগে।"
আন্নামা একজন সফল কণ্ঠশিল্পী, আবৃত্তি শিল্পী, এবং চিত্রশিল্পী। সে সোপানে আবৃত্তি ও শিল্পকলার শিক্ষা গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি সিটি ব্যাংকে অফিসার হিসেবে যোগদান করার মাত্র এক মাস পাঁচ দিনের মাথায় সে পুরো সিলেট অঞ্চল থেকে "থ্যাংক ইউ" কার্ড পেয়ে প্রমাণ করেছে তার নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও কাজের প্রতি গভীর ভালোবাসা। তার এই অসাধারণ সাফল্য আমার জন্য গর্বের। আন্নামার মতো সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমেই মানুষ মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে।
আজকের এই শিক্ষক দিবসে আমি সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের প্রতি অনুরোধ জানাই, আসুন আমরা আমাদের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করি। কারণ, শিক্ষক হলেন সেই মানুষ, যাঁর আন্তরিকতা ও ভালোবাসার মাধ্যমেই একটি আলোকিত সমাজ ও জাতি গঠন সম্ভব।
মেধা-মননে একটি স্বপ্নের সেতুবন্ধন তৈরি করি, যা আমাদের নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক সম্পর্কগুলোকে আরও দৃঢ় করবে। কারণ, কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে অনন্তকাল।
জীবনের এই চক্র একদিন পেন্ডুলামের মতো থেমে যাবে, কিন্তু আমাদের কর্ম রয়ে যাবে। সেই কর্মগুলো হোক সৎ ও মহান।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সকল শিক্ষকের প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখক: কর্মকর্তা (অবঃ), বিআরডিবি, পল্লী ভবন, ঢাকা-১২১৫। anwaraftab611@gmail.com