১৯৭১ এর রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ আর বিজয় পরবর্তী বাংলাদেশ দূর্ভাগ্যক্রমে সাধারণ মানুষের বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারেনি। অপার বিস্ময়ে সর্বস্ব হারানো মানুষগুলো দেখেছে বঞ্চনা আর প্রতারণার নবরূপ, যে বৈষম্যের কারনে আমরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম সেটাই ১৯৭২ সালে সর্বগ্রাসী আওয়ামী চেহারা ধারন করে আবির্ভূত হয়েছে মূর্তিমান বিভিষিকা হয়ে।
একদিকে দুগ্ধপোষ্য শিশুর জন্য এক কৌটা গুড়া দুধের জন্য না পাওয়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন পিতা ন্যায্যমূল্যের দোকানের সামনে প্রতীক্ষার লাইনে কাটিয়েছেন সারারাত। ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ঠের যুদ্ধ চলেছে মানুষে-কুকুরে। কলাপাতায় দাফন হয়েছে মৃতদেহ। লজ্জা নিবারণে বাসন্তীর গায়ের জালের লজ্জা থেকে আজও মুক্তি জোটেনি আমাদের। রক্ষী বাহিনীর ক্রসফায়ার আর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে হাজার হাজার তরুণ যুবকের মৃত্যুর বিষয় ছিলো প্রতিদিনের খবর।
আর অন্য দিকে নির্বিচার সম্পত্তি দখল, প্রভাবশালীদের ব্যাংক ডাকাতি, সোনার মুকুটে জাতীয় রাজপুত্রদের বর্নাঢ্য বিয়ের অনুষ্ঠানে স্বাক্ষী হতে হয়েছে অসহায় দেশবাসীকে । তথাকথিত জাতীয় সংসদের সিদ্ধান্তে মানুষ হয়েছে বাকশালের কৃতদাস আর সংবাদপত্র হারিয়েছে তার প্রাপ্য স্বাধীনতা।
সেদিনের এমনি অন্ধকার বাংলাদেশে ১৫ই আগস্ট এসেছে ঐতিহাসিক প্রয়োজনে। ঘটনাবহুল আগস্টের পর নৈরাজ্যের প্রান্তসীমানায় পৌছে যাওয়া দিশাহীন দিকহারা বাংলাদেশে প্রয়োজন ছিলো এমন একজন নেতার যিনি এই অন্ধকার অনিশ্চিত বাংলাদেশকে দিতে পারেন প্রকৃত দিশা। আশ্বস্ত করতে পারেন হতাশ জাতিকে, দেখাতে পারেন সম্ভাবনার স্বপ্ন।
বাংলাদেশে শহীদ জিয়া এলেন, শক্ত হাতে ধরলেন হাল, আস্বস্ত করলেন, আর সেই নিমজ্জিত সমগ্র বাংলাদেশকে ঠিক যেমনটি করেছিলেন ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার মহান সাহসী ঘোষণা নিয়ে- হতবিহবল , আক্রান্ত আর দিশাহীন মানুষের সামনে আশার আলো হয়ে।
৭ নভেম্বর আমাদের দিয়েছে এক অভূতপূর্ব ঐক্যের উদাহরণ- সিপাহী জনতার এক অনাবিল মেলবন্ধন। মানুষের মনে জেগে ছিলো এক পরিবর্তনের প্রত্যাশা সত্যিকারের দেশ পাল্টে দেয়া সংস্কারের সেটাই শুভ সূচনা।
৭ নভেম্বর আমাদের মুক্ত করেছে আওয়ামী বাকশালী পরাধীনতার বিভীষিকা থেকে। শহীদ জিয়া একদলীয় বাকশালী কারাগারে থেকে আমাদের দিয়েছেন মুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। জিয়ার সেই মুক্তির সনদে অনেকের সাথে মৃত আওয়ামী লীগেরও হয়েছে পুনর্জন্ম সংখ্যায় চারটিতে নেমে আসা কণ্ঠরুদ্ধ সংবাদপত্র পেয়েছিল অবারিত মুক্তির স্বাদ, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অবলুপ্ত বাক স্বাধীনতা।
শহীদ জিয়ার সংস্কার ভাবনার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমাদের সংবিধানকে জন-আকাঙ্ক্ষা, আমাদের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের সাথে সমর্থক করে তোলা। সংবিধানের শীর্ষে স্থান পেয়েছে “বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম”-এর মতো পবিত্রতম উচ্চারণ। সংযুক্ত হয়েছিল মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস হবে সকল কাজের ভিত্তি’র মতো প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ যা আজও সংখ্যাগরিষ্ঠের অন্তরের চাহিদা।
সেদিনে বাংলাদেশে ঐক্য আর আস্থার সমার্থক নাম ছিল শহীদ জিয়া, আর সেই ঐক্য বন্ধন দৃঢ়তর করতে তিনি দিয়েছিলেন এক অবিস্মরণীয় দর্শন- আমাদের গৌরবের জাতীয় পরিচয় ‘আমরা বাংলাদেশী’। এই একটি উচ্চারনের সাথে সাথে দেশের সকল মানুষের কন্ঠে- পাহাড়, সমতল, দ্বীপ, প্লাবনভূমি, ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত নির্বিশেষে সমান অধিকার আর গর্বের সাথে উচ্চারিত হয়েছে সেই অসামান্য জাতীয়তার নাম।
তাঁর হাতে ছিলো জনগণকে সম্মোহিত করার এক যাদুরকাঠি, তিনি জানতেন আর্থিক ভিত্তি শক্ত না হলে স্বাধীনতা হবে অর্থহীন । শ্রান্তি-ক্লান্তিহীন জিয়া প্রথম দিন থেকেই ছিলেন মাঠে কোদাল কাস্তে হাতে সাধারণের পাশে। সেই বংশীবাদকের ডাকে স্বতঃস্ফূর্ত জনগণ খাল কেটেছেন মাইলের পর মাইল, মুখে নেই কষ্ট, ক্লান্তির ছাপ। সেচের পানিতে এক ফসলা জমি রূপান্তরিত হয়েছে দু-ফসলতে, দু-ফসলা তিন ফসলাতে। তিন বছর না পার হতেই দুর্ভিক্ষের বাংলাদেশ হয়েছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, বেড়েছে ক্ষুদ্র আর কুটির শিল্পের সংখ্যা। অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে নতুন দুটি নাম- মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম রপ্তানি আর গার্মেন্টস শিল্পের সূচনা।
গ্রামের কর্মহীন বেকার যুবক পরিণত হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্মানিত যোদ্ধায় আর অবরোধ বাসিনী বোনেরা হয়েছেন স্বাবলম্বী, পরিবারে হয়েছেন সম্মানিত। শিক্ষায় এসেছে সংস্কারের অবিশ্বাস্য সুবাতাস, আওয়ামী প্রতিষ্ঠিত রোগ আক্রান্ত শিক্ষা ব্যবস্থা হয়েছে নকলমুক্ত, সূচনা হয়েছে বয়স্ক শিক্ষার, শিক্ষা বঞ্চিত কিশোরীরা হয়েছে বিদ্যালয় মুখী।
অসম্ভব দূরদর্শী ভাবনায় শহীদ জিয়ার সাথে অনাবিষ্কৃত বাংলাদেশকে চিনতে বঙ্গোপসাগরে সফর সঙ্গী হয়েছেন দেশের মেধাবী তরুণ তরুণীরা। স্থলভাগের প্রায় সমপরিমাণ জলরাশির সাথে পরিচিত হবার এক মনোমুগ্ধকর স্মৃতি। সংস্কৃতির জগত দেখেছে এক যুগান্তকারী আত্মপরিচয় প্রচেষ্টার দৃষ্টান্ত। নতুন কুঁড়ির মতো অসাধারণ প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান- যা ছিল আমাদের সংস্কৃতিতে আবিষ্কার আর তার স্রোতধারা বহমান রাখার এক অবিস্মরণীয় প্রয়াস।
আমাদের সবচাইতে গৌরবদীপ্ত অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংকলন, সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, মহান একুশে আর স্বাধীনতা পদক প্রবর্তনের মতো অসামান্য সিদ্ধান্ত যেনো এতদিন শহীদ জিয়ার প্রতীক্ষায় ছিলো। বাংলাদেশকে বদলে দেয়ার এই সংস্কার ভাবনার ছোঁয়া- আঞ্চলিক আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনকেও করেছিল দীপ্তমান। জাতিসংঘের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলো সবাইকে অবাক করে জাপানকে পরাজিত করে। জিয়া শুধু সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না বরং সেটিকে বাস্তবায়নের কাছে নিয়েছিলেন জটিল আঞ্চলিক কূটনীতিকে তার দক্ষতায় সহজ করে। ওআইসির আল-কুদছ কমিটির সদস্য হিসেবে অবসান করেছিলেন ভ্রাতৃঘাতী ইরাক-ইরান যুদ্ধের।
অবিশ্বাস্য দূরদর্শিতায় উঠতি অর্থনীতির বাংলাদেশের মত একটি দেশের রাষ্ট্রপতির অবিস্মরণীয় স্থায়ী পবিত্র আরাফাত ময়দানের ধুসর মরূভূমিতে শীতল সবুজের প্রতিচ্ছবি “জিয়া-ট্রি” হয়ে। এই বিস্তীর্ণ সবুজের সমারোহ যতদিন আরাফা’র ময়দানে মাথা উচু করে থাকবে ততদিন বাংলাদেশ আর শহীদ জিয়া বেঁচে থাকবেন ইসলামিক জগতের প্রতিটি মানুষের মাঝে।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা থেকে বাংলাদেশের সকল ক্রান্তিকালে জড়িয়ে থাকা অবিস্মরণীয় নাম শহীদ জিয়া ও জিয়া পরিবার। দেশের সকল ক্রান্তিকালে - সকল দূর্যোগ মূহুর্তে এই পরিবারের অপরিহার্যতা আজ কোন প্রমানের অপেক্ষায় নেই ।
গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় যেমন শহীদ জিয়া , তেমনি সংসদীয় গণতন্ত্র আর সুষ্ঠু নিরপেক্ষ আর অবাধ নির্বাচনের নিশ্চয়তার সাথে জড়িয়ে আছেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া- ঠিক তেমনি বিধ্বস্ত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা ৩১ দফা দিয়ে জাতির সামনে তারূণ্যের সামনে এক আগামীর প্রত্যাশার আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন জনাব তারেক রহমান।
সাহসী, কর্মঠ, সৎ ভবিষ্যৎদর্শী, সৃজনশীলতা আর দেশপ্রেমের অনুপম নিদর্শন হয়ে যেমন চিরজাগরুক হয়ে আছেন শহীদ জিয়া, জনতার ভালোবাসায় অভিষিক্ত জিয়ার অন্তিম বিদায়ত্ব ছিলো আত্মার আত্মীয়কে বিদায় দেবার বেদনা বিধূর এক অপূর্ব-অভূতপূর্ব শোকগাঁথা হয়ে।
দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ আর শুধু কোন দলের বেষ্টনীতে আবদ্ধ নয়, মমতা আর মাতৃরূপের অনাবিল প্রতিচ্ছবি। দেশমাতা আজ প্রকৃতই দেশের অবিভাবক। আজ এদেশে সবচাইতে সম্মানিত আর মর্যাদার নাম বেগম খালেদা জিয়া।
আজ পঞ্চাশ বছর পূর্তির শুভক্ষনে আরেক ৭ নভেম্বর দীপ্তিমান সুবর্ণজয়ন্তীর গৌরবে, সংস্কারের নবপ্রত্যাশায় অপেক্ষমান বাংলাদেশ, তারূন্য-নবীন-প্রবীন সবাই। বাংলাদেশ জানে জিয়া পরিবার আর বাংলাদেশ আজ অবিচ্ছেদ্য দুটি নাম।
সংস্কার ভাবনা বাস্তবায়নের আরেক জিয়ার নাম তারেক রহমান- তার হাতে নতুন বাংলাদেশ নব প্রত্যাশার নব জাগরনের নব সম্ভাবনায় দ্বার প্রান্তে- আগামীর সুপ্রভাত সেই তারূণ্যের আগমন আর অভিষেকের প্রতীক্ষায় ।
লেখক: আহবায়ক, বিএনপি মিডিয়া সেল।