
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী এলাকার এক রত্নসদৃশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হলো টাঙ্গুয়ার হাওর। এটি শুধু জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির অঙ্গনেও গভীর প্রভাব ফেলে। রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃত এই হাওর একসময় ছিল অগণিত পাখি, মাছ ও জলজ উদ্ভিদের আশ্রয়স্থল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পর্যটনের অপ্রতিরোধ্য থাবা এবং মানুষের কার্যক্রমের কারণে হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্য্য কেবল পানি ও গাছপালায় সীমাবদ্ধ নয়। এখানে রয়েছে অসংখ্য আকর্ষণীয় ভ্রমণকেন্দ্র। মেঘালয়ের পাহাড় আর নীল জলরাশির মাঝে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে রয়েছে বারিক্কা টিলা। এখানে একটি সীমানা পিলারে চার পাশে ঘুরলেই বাংলাদেশ ও ভারত ভ্রমণ হয়ে যায় ভিসা ছাড়াই। এখান থেকে যাদুকাটা নদী পাড় হয়ে মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়গুলো এক অপূর্ব মায়াময় দৃশ্যের অবতারণা করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখা টেকেরঘাট যেমন ইতিহাসের অংশ তেমনি এর পাশেই চুনাপাথরের লেক যা নীলাদ্রী লেক কিংবা শহীদ সিরাজ লেকের স্বচ্ছ নীল জলের জন্য পরিচিত। এখানের উচু টিলার এক পাশে ভারতীয় পাহাড়, অন্য পাশে হাওর। তারই মাঝে এই লেকে কায়াকিং ছাড়াও এর শীতল পানিতে গোসল করার এক ভিন্ন আমেজের সৃষ্টি করে।
ভারতের মেঘালয়ের পাহাড় থেকে প্রবাহিত যাদুকাটা নদী নদী ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। নদীর পানি এবং দুই পাশে ছড়িয়ে থাকা সবুজ গাছপালা এক অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য উপহার দেয়। বিশেষ করে সূর্যাস্তের সঙ্গে আকাশ ও হাওরের মিলনের মোহময়তা ছাড়িয়ে যায় জীবনের সকল রঙকে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ছাড়াও শিমুল বাগান এবং লাকমাছড়া ঝর্ণা পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। শিমুল বাগানের লাল ফুলগুলো বসন্তের সময় হাওরের সবুজের সঙ্গে চমৎকার সমন্বয় ঘটালেও সে হাওরে পানি থাকে না, পর্যটকরাও খুব একটা আসেনা। পর্যটন মৌসুমে সমুজ শিমুল বাগাও পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
লাকমাছড়া ঝর্ণার শান্ত ও পরিস্কার জলপাতে অনেকেই ভ্রমণ ও ছবি তোলার জন্য ভিড় করেন। হাওরের মাঝখানে নির্মিত ওয়াচ টাওয়ার থেকে পুরো হাওরের বিস্তীর্ণ দৃশ্য চোখে পড়ে, যেখানে হাওরের জল, টিলা, নদী এবং সবুজ গাছপালার এক অপূর্ব মিলন দেখা যায়। এই জায়গা থেকে পাখি পর্যবেক্ষণও করা যায়, বিশেষ করে শীতকালে যখন হাওরে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি ভিড় করে। টাওয়ারের স্থায়িত্ব রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন লাল পতাকা টানিয়ে সীমানা দিয়েছে। যাতে ওই এলাকায় হাউসবোটগুলো প্রবেশ করতে না পারে। ফলে হাউসবোট থেকে পর্যটকদের টাওয়ারে নিয়ে যেতে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা আসে। একে কর্মরত বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্য্য স্বচ্ছ জল, সুনিপুণভাবে ছড়িয়ে থাকা জলজ গাছপালা, এবং হাজার হাজার পাখির আনাগোনা দেখে যে কেউ বিমোহিত হতে বাধ্য। হাওরের সবুজ জলজ উদ্ভিদ যেমন হিজল, করচ, এবং অন্যান্য জলজ গাছপালা একসময় সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা বয়ে আনত। এরা মাটি আঁকড়ে ধরে হাওরের বাঁধ ও তটরক্ষা করত, পাশাপাশি মাছ ও কাঁকড়া প্রজাতির জন্য আশ্রয়স্থল হিসেবেও কাজ করত। তবে বর্তমানে পর্যটনের বিস্তার ও হাউসবোটের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এই প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভেঙে যাচ্ছে।
পর্যটকরা টাঙ্গুয়ার হাওরের নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে হাউসবোটে ভ্রমণ করেন। এই হাউসবোটের সংখ্যা বর্তমানে কয়েকশ'র উপর, যা হাওরের পানি ও তটের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকার শব্দ ও তেলজাত পদার্থের কারণে পানিতে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে, যা মাছের প্রজনন হ্রাস করছে। স্থানীয় এবং পরিযায়ী পাখির অভ্যন্তরীণ বাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেক প্রজাতি হাওর ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। রাতের বেলায় হাউসবোটের লাইট এবং লাউডস্পিকার শব্দে প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনচক্র বিপর্যস্ত হচ্ছে।
এই সমস্যা শুধু প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের ওপরই সীমাবদ্ধ নয়। হাওরের পরিবেশগত ক্ষতি সরাসরি স্থানীয় মানুষের জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে। মাছ, কাঁকড়া, হিজল ও করচের মতো প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল এখানকার মানুষদের জীবিকা হুমকির মুখে। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা এবং নারী-পুরুষেরা হাওরের মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত থাকলেও বর্তমান সময়ে মাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় তাদের আয়ও কমে যাচ্ছে। ফলে সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থাও প্রভাবিত হচ্ছে।
পর্যটকরা টাঙ্গুয়ার হাওরের স্বপ্নময় দৃশ্য উপভোগ করতে আসলেও অতিরিক্ত ভ্রমণ ও হাউসবোটের চাপ হাওরের পরিবেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। হাজার হাজার পর্যটক এসে হাওরের তীরে প্লাস্টিক, খাদ্যের অবশিষ্টাংশ, এবং অন্যান্য আবর্জনা ফেলে যাচ্ছেন। এ ধরনের দূষণ শুধুমাত্র পানির গুণগতমান কমাচ্ছে না, বরং মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর মৃত্যুও বাড়াচ্ছে। এছাড়াও হাওরের তটরেখায় হিজল, করচ ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ চারণের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
হাওরের ভ্রমণস্থলগুলোও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন নৌপথ ধরে ভ্রমণ করলে দেখা যায়, পানি-জঙ্গল ও সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্যের অপূর্ব সংমিশ্রণ। হাওরের মধ্য দিয়ে নৌকাভ্রমণে অতিথিরা ঝর্ণা, হ্রদ এবং ছোট ছোট দ্বীপের সৌন্দর্য দেখতে পান। এই ভ্রমণকেন্দ্রগুলোতে পাখি পর্যবেক্ষণ ও মাছ ধরা যেমন জনপ্রিয়, তেমনি ফটোগ্রাফির জন্যও এটি স্বর্গসদৃশ। তবে এই সৌন্দর্য্য রক্ষা করতে না পারলে ভ্রমণও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
প্রতি বছর এখানে দেশি ও বিদেশি হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি আসে। বসন্ত ও শীতকালে হাওরের পাখি ও জলজ প্রাণী হাওরের জলজ গাছপালা ও প্রাকৃতিক আশ্রয়ে আশ্রয় নেয়। এই প্রাকৃতিক চক্র বর্তমানে ভঙ্গুর। হাওরের জলজ উদ্ভিদের হ্রাস ও পর্যটনজনিত চাপের কারণে পাখির সংখ্যা দিনদিন কমছে। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে টাঙ্গুয়ার হাওর অচিরেই পৃথিবীর মানচিত্রে প্রাকৃতিক নিঃসৃতির জন্য এক বিপন্ন অঞ্চলের রূপ নিতে পারে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় হাওরের সংরক্ষণের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। হাওরের একাংশে হাউসবোটের সংখ্যা সীমিত করা, মাছ ধরার নিয়মকানুন কঠোর করা, এবং জলজ উদ্ভিদ পুনঃরোপণ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও স্থানীয় জনগণও সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছেন। শিক্ষামূলক প্রচারণা, হাওর সংরক্ষণে কমিউনিটি প্রজেক্ট, এবং পর্যটকদের সচেতন করার জন্য বন্দর ও ট্যুর গাইডদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
তবে এই প্রতিবেশগত সংকটের সমাধান এখনও চ্যালেঞ্জিং। হাওরের চারপাশের নগরায়ন ও মানুষদের জীবনযাত্রার পরিবর্তন হাওরের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। তাই প্রয়োজন স্থানীয় জনগণকে সহায়তা করে টেকসই পদ্ধতিতে হাওরের ব্যবহারের নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়াও হাওরের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে সরকারকে আরও কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হবে।

পর্যটকরা হাওরের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে আসলে তাদের আচরণেও পরিবর্তন আনা জরুরি। প্লাস্টিক এবং অন্যান্য দূষণযোগ্য পদার্থ ফেলা থেকে বিরত থাকা, নির্ধারিত নৌকাপথ ব্যবহার করা, এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতা করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি হাওরের জীববৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া অপরিহার্য। এই ছোট্ট পদক্ষেপগুলো মিলিয়ে মিলিয়ে হাওরের দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণে বড় ভূমিকা রাখবে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্য্য, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং ভ্রমণ আকর্ষণগুলো একসাথে বিবেচনা করলে দেখা যায়, এটি শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য মূল্যবান একটি জলজ সম্পদ। যদি হাওরের ক্ষয় ও দূষণ অব্যাহত থাকে, তবে একটি সুন্দর ভ্রমণকেন্দ্র এবং জীববৈচিত্র্যের রূপকথার জগৎ হারিয়ে যাবে।
এই মুহূর্তে আমাদের দায়িত্ব হলো সচেতনতা সৃষ্টি করা। স্কুল, কলেজ, এবং সামাজিক মাধ্যমে হাওরের গুরুত্ব ও সমস্যার বিষয়ে শিক্ষামূলক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে মিলে হাওরের জলজ উদ্ভিদ পুনঃরোপণ, মাছ সংরক্ষণ এবং পর্যটন ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও পর্যটন ব্যবসায়ীদেরও এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা উচিত।
এতো সবের পরেও টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। যদি আমরা আজ সচেতন না হই, তবে আগামী প্রজন্ম এই প্রাকৃতিক ধন-সম্পদকে কেবল বই ও ছবিতে দেখবে। হাওরের নীল জল, সবুজ জলজ উদ্ভিদ, সাদা পাখি, এবং নৌকাভ্রমণের আনন্দ হারিয়ে যাবে। কিন্তু যদি আমরা সকলে মিলে সংরক্ষণে উদ্যোগ নিই, তাহলে টাঙ্গুয়ার হাওর এক অভিন্ন সৌন্দর্য্যের ও জীববৈচিত্র্যের প্রতীক হয়ে থাকবে। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, পুরো বিশ্বকেই শিক্ষা দেবে যে প্রকৃতি এবং মানুষের সহাবস্থান সম্ভব।
টাঙ্গুয়ার হাওর আমাদের স্বপ্নময় প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি রক্ষা করতে হলে সরকারের, বেসরকারি সংস্থা, স্থানীয় জনগণ এবং পর্যটকদের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। শুধুমাত্র তখনই আমরা এই জলের জগৎ, পাখি ও মাছের স্বর্গ, এবং সবুজ গাছের সমৃদ্ধ হাওরকে আগামী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করতে পারব। হাওরের প্রতিটি তরঙ্গ, প্রতিটি পাখির উড়ান, এবং প্রতিটি হিজল বা করচের শেকড় আমাদের সতর্কবার্তা দিচ্ছে—“আমাকে রক্ষা করো, আমি তোমাদের জীবনও রক্ষা করব।”
পর্যটন হোক আনন্দময়, জীবন হোক স্থিতিশীল, এবং প্রকৃতি অটুট থাকুক-এটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। টাঙ্গুয়ার হাওরের নীল জল আর সবুজ গাছপালার মাঝে এই সতর্কবার্তা যেন প্রতিদিন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া কোনো উন্নয়ন স্থায়ী নয়।
লেখক: নির্বাহী সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেইঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (সাকজেএফ)।