ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪ বছরের ইতিহাস কেবল শিক্ষার ইতিহাস নয়, বরং এ দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। এই ইতিহাসের কেন্দ্রে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, ডাকসু। ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে শুরু হওয়া ডাকসুর পথচলা দীর্ঘ শতাব্দী ধরে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার, নেতৃত্ব বিকাশ ও জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখার এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও শত বছরের মধ্যে হয়েছে মাত্র ৩৭ বার। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে নির্বাচনের সংখ্যা মাত্র সাতবার। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে কতটা অবহেলা, দলীয় প্রভাব ও দখলদারিত্বের কারণে একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রথমদিকে ডাকসু মূলত সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণকেন্দ্রিক একটি মঞ্চ ছিল। কিন্তু পঞ্চাশের দশক থেকে এটি পরিণত হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্মভূমিতে। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কিংবা মুক্তিযুদ্ধ—সবখানেই ডাকসুর ভূমিকাই ছিল কেন্দ্রীয়। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, পরবর্তীকালে ছাত্রদল—সব সংগঠনের নেতারা ডাকসুর মঞ্চ থেকে উঠে এসেছেন। সে কারণে ডাকসু কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সংসদ নয়, বরং জাতীয় রাজনীতিরও প্রতিফলন। ডাকসুর রাজনৈতিক উত্থানের সূচনা হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই আন্দোলনের মূল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ডাকসুর তৎকালীন নেতারা সামনের সারিতে ছিলেন। এরপর ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, যার সূত্রপাতও হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাত ধরে, ডাকসুর নেতৃত্বেই তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, সেখানেও ডাকসু এক অনন্য ভূমিকা রেখেছিল। এই সময়ের নেতারা কেবল শিক্ষার্থীদের দাবিই নয়, বরং জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষাকেও ধারণ করে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি ও জিএস-এর নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, যা গণআন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। এই আন্দোলনের তীব্রতা এতটাই ছিল যে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ডাকসুর ভূমিকা ছিল আরও সুদূরপ্রসারী। তৎকালীন ডাকসুর মঞ্চে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়েছিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে। এই সময়ের ডাকসু নেতারা কেবল ছাত্রনেতা ছিলেন না, তারা ছিলেন জাতির মুক্তির দিশারী।
স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক দলগুলোর দখলদারিত্ব ডাকসুকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয়। ১৯৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষের নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান ভিপি-জিএস নির্বাচিত হলেও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়নি। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের দ্বন্দ্ব নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ভেঙে দেয়। এর পর থেকে অনিয়ম, সহিংসতা ও স্থগিতকরণই হয়ে ওঠে ডাকসুর নিয়তি। সত্তর ও আশির দশকে ডাকসুতে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমান উল্লাহ আমান, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মনসুর আহমদ প্রমুখ, যারা পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্র ফিরে এলেও ডাকসু নিয়মিত নির্বাচনের মুখ দেখেনি। কারণ সহজ—ক্ষমতাসীন দলগুলো ভয় পেত, নির্বাচনে তাদের ছাত্রসংগঠন হারলে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ হারাবে। গত তিন দশকের অভিজ্ঞতাই সেই আশঙ্কা সত্য করেছে। ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুরু করে। গেস্টরুম ও গণরুম সংস্কৃতি চালু হয়, যেখানে নতুন শিক্ষার্থীরা জোরপূর্বক রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে বাধ্য হয়। শিক্ষার্থীদের ওপর দলীয় চাপ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এক নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা তাদের কণ্ঠস্বর প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হারিয়ে ফেলে, এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় দলীয় প্রভাব বিস্তারের একটি কেন্দ্রে।
দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও তা আস্থাহীনতার জন্ম দেয়। সহিংসতা, কারচুপি এবং প্রশাসনিক পক্ষপাতের অভিযোগে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপার ভর্তি ব্যাগ পাওয়ার ঘটনা, এবং নির্বাচনের দিন বিভিন্ন কেন্দ্রে ছাত্রলীগের বহিরাগতদের উপস্থিতি ও বলপূর্বক ভোট দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। নুরুল হক নূর ভিপি নির্বাচিত হলেও ছাত্রলীগ অধিকাংশ পদে জয়ী হয়। নির্বাচনের পর ডাকসু প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের মৌলিক সমস্যা সমাধানে খুব একটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেননি, যার ফলে শিক্ষার্থীরা মনে করে ডাকসু আর তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে না, বরং এটি দলীয় স্বার্থের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই ব্যর্থতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি ও ডাকসু সম্পর্কে এক গভীর হতাশা তৈরি করে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থান ক্ষমতার সমীকরণ পাল্টে দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দীর্ঘ দখলদারিত্ব ভেঙে পড়ে। শিক্ষার্থীরা গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতি, জোরপূর্বক মিছিলে অংশগ্রহণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। এ পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের নতুন করে প্রত্যাশা তৈরি করেছে। এবারকার নির্বাচনের মূল ইস্যু হলো দখলদারিত্বের অবসান, গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতির সমাপ্তি, সুলভ মূল্যে ক্যানটিনে খাবার, এবং একটি শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাস। নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আহমেদ সজীবের ভাষায়, “সবাই যাতে প্রথম বর্ষে এসেই হলে সিট পান, গণরুম-গেস্টরুম যাতে আর ফিরে না আসে, ক্যানটিনে সুলভ মূল্যে ভালো খাবার পাওয়া যায়—এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন, এমন প্রতিনিধিই আমরা চাই।” এই বক্তব্যটি কেবল একজন শিক্ষার্থীর নয়, এটি হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মনের কথা।
এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ৩৯,৭৭৫ জন। ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৭১ জন প্রার্থী, এর মধ্যে ৬২ জন নারী। সদস্য পদে প্রার্থী সংখ্যা সর্বাধিক—২১৭ জন। পাশাপাশি ১৮টি হল সংসদে মোট ১,০৩৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রতিটি পদে একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যা গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার বার্তা বহন করে। এই নির্বাচনের মূল বিষয়গুলো কেবল রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা সরাসরি শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের একক আধিপত্যে ক্যাম্পাসে যে গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতি, রাজনৈতিক চাপ ও সহিংসতা ছিল, তার অবসানই এবারের নির্বাচনের প্রধান এজেন্ডা। বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের প্রচারে এই বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন।
ভিপি পদের জন্য এবার ৪৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবিদুল ইসলাম খান (ছাত্রদল), উমামা ফাতেমা (স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য), সাদিক কায়েম ও ইয়াসিন আরাফাত। জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৯ জন, যার মধ্যে রয়েছেন আবু বাকের মজুমদার (বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ), তানভীর বারী হামিম, এস এম ফরহাদ এবং অন্যরা। এই বিশালসংখ্যক প্রার্থীর মধ্যে কে বিজয়ী হবেন, তা বলা কঠিন, তবে শিক্ষার্থীদের মূল মনোযোগ হলো এমন প্রার্থীদের দিকে, যারা দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে পারবেন। স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা তার বক্তব্যে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ এবং ডাকসুর হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা নির্বাচিত হলে সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীতের স্বাক্ষর রাখার চেষ্টা করব। তবে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানকেন্দ্রিক বিষয়গুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দেব।” উমামার এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে তারা কেবল বড় রাজনৈতিক ইস্যুতেই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদা যেমন—হলগুলোতে সিট নিশ্চিত করা, ক্যানটিনে মানসম্পন্ন ও সুলভ মূল্যে খাবার সরবরাহ, এবং একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস পরিবেশ তৈরির দিকেও গুরুত্ব দেবেন। অন্যদিকে, ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান সরাসরি গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতির নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি নির্বাচিত হলে প্রথম কাজ হবে ক্যাম্পাসে এবং হলগুলোতে আর কখনো গণরুম ও গেস্টরুমের সংস্কৃতি ফিরে আসতে দেব না।” আবিদুলের এই বক্তব্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে, কারণ এই সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের এক প্রধান উৎস ছিল। আরেকজন ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম তার প্রার্থীত্বকে শিক্ষার্থীদের মূল সমস্যা সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করার প্রতিশ্রুতি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে ক্যাম্পাসের সকল শিক্ষার্থী যেন সমান সুযোগ পান, বিশেষ করে হল সিট বরাদ্দ ও ক্যানটিনের সুলভ খাবার সংক্রান্ত ক্ষেত্রে। এছাড়া তিনি শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার এবং গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতি নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইয়াসিন আরাফাত নামের আরেকজন ভিপি প্রার্থী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়ন, সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার বিকাশ এবং হল সংসদ কার্যক্রমকে আরো কার্যকর করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি শিক্ষার্থীদের সমস্যা ও দাবি সমাধানের জন্য প্রতিনিয়ত কার্যক্রম গ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্যানেল, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার ডাকসুকে তার পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা ডাকসুকে সেই পুরোনো গৌরবের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে চাই।” এই প্যানেল মূলত জুলাই মাসের গণআন্দোলনের চেতনাকে সামনে রেখে গঠিত হয়েছে এবং তাদের মূল লক্ষ্য হলো ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা।
২০১৯ সালের নির্বাচনের অনিয়ম শিক্ষার্থীদের মনে এখনো তাজা। এবার নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো আস্থা ফিরিয়ে আনা। প্রতিটি কেন্দ্রে নিরাপত্তা, সিসিটিভি ব্যবহার, ভোট গণনায় স্বচ্ছতা এবং প্রতিনিধিদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীরা আর কোনো প্রহসন দেখতে চান না। একমাত্র সুষ্ঠু নির্বাচনই পারে ডাকসুর মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে। ডাকসু নির্বাচন কেবল নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়া নয়, এটি এক আন্দোলন। এটি শিক্ষার্থীদের আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্র, তাদের অধিকার আদায়ের মঞ্চ, এবং গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণআন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন—সবখানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সামনের সারিতে ছিলেন। ডাকসু ছিল সেই নেতৃত্বের উৎস। প্রবীণ শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, “ডাকসু শুধু রাজনৈতিক নয়, নানা ক্ষেত্রে নেতৃত্ব তৈরি করেছে—সংস্কৃতি, সাহিত্য, ক্রীড়াক্ষেত্রেও।” এই বহুমাত্রিক ভূমিকা দীর্ঘদিন ধরে হারিয়ে গিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের নতুন প্রজন্ম আবারও চাইছে সেই প্ল্যাটফর্ম ফিরে আসুক।
ডাকসুর গঠনতন্ত্র শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক, ক্রীড়া, সামাজিক কার্যক্রম ও প্রকাশনা কাজে জোর দেয়। ২০২৫ সালের জুনে সিন্ডিকেট নতুন তিনটি সম্পাদকীয় পদ সংযোজন করেছে—মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক এবং ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক। বয়সসীমাও তুলে নেওয়া হয়েছে। এসব পরিবর্তন ডাকসুকে আরও সময়োপযোগী করে তুলতে পারে। প্রশ্ন একটাই—এ নির্বাচন কি সত্যিই সুষ্ঠু হবে? দলীয় প্রভাব কি আবারও গ্রাস করবে? স্বাধীনতার পর থেকে অন্তত ৭৫টি খুন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যার বড় অংশ দলীয় দখলদারিত্বের ফল। সাড়ে ১৫ বছর ছাত্রলীগের দখলে নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তাই এবারের নির্বাচন শিক্ষার্থীদের মুক্তির পথ হতে পারে। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে ডাকসু আবারও শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠতে পারে। অন্যথায় এটি আরেকটি দলীয় যন্ত্রে পরিণত হবে।
ডাকসু নির্বাচন কেবল শিক্ষার্থীদের ভোটের লড়াই নয়, বরং হারানো গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণের সন্ধিক্ষণ। এটি শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণের লড়াই, দখলদারিত্বমুক্ত ক্যাম্পাসের লড়াই এবং আগামী দিনের নেতৃত্ব গড়ে তোলার লড়াই। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, তবে ডাকসু আবারও হয়ে উঠবে সেই কেন্দ্র যেখানে গড়ে উঠবে আগামী দিনের জাতীয় নেতৃত্ব, বিকশিত হবে সংস্কৃতি ও ক্রীড়া, এবং গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক। আর যদি ব্যর্থ হয়, তবে শিক্ষার্থীদের আস্থাহীনতা আরও গভীর হবে, যা দেশের ভবিষ্যতের জন্যও অশনিসংকেত।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব