কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে গত পঞ্চাশ বছর ধরে অবিশ্রান্ত কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত, নদী-নালা-খাল-বিল পাহাড়-সমুদ্র কোনো একটি ভৌগলিক স্থান নেই যেখানে তাঁর পদছাপ থেকে বঞ্চিত হয়নি। কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নের জন্য তিনি দৌড়েছেন। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মাটি ও মানুষ নামে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করে দেশ বিদেশে তিনি পরিচিতি পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে এসে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আইতে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ নামে অনুষ্ঠান করছেন। এই অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কৃষকের কথা শুনেছেন। তাদের অভিজ্ঞতা নিজের ভেতর আত্মস্থ করেছেন। কৃষকের উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন। এখন তিনি কিংবদন্তী তুল্য মহীরুহ। তিনি সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও দেশের কৃষিকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বিদেশের প্রযুক্তিকে দেশীয় কৃষির উন্নয়নে কাজে লাগিয়েছেন। কৃষির এই আধুনিকায়নে নিজেকে পুরো উজাড় করে দিয়েছেন। একটি আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে কৃষিকে সহজিকরনে কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর।
এই কৃষকরা এস এম সুলতানের পেশীবহুল চিত্রকলার মতো শরীর নিয়ে কাজ করেন। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে মেটেল শরীরে অর্থনীতিকে জীবন দিচ্ছেন। গ্রামীণ যে অর্থনীতি সেই অর্থনীতিকে ভেঙে আধুনিক একটি কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
রাষ্ট্র পরিবর্তন হয়, সমাজ পরিবর্তন হয়, সরকার পরিবর্তন হয় কিন্তু কৃষকের জীবনের কোনো উন্নয়ন হয়নি। এটা শাইখ সিরাজের একটা দুঃখ। দেশের অর্থনীতিতে কৃষকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কৃষির উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন শাইখ সিরাজ। নতুন একটি ফসলের আবির্ভাব ঘটলে সেটিকে আমাদের দেশের কৃষককে উৎপাদনের জন্য উৎসাহ প্রদান করেন। সেচের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি, ধান কাটার জন্য মেশিন, জমি চাষের জন্য ট্রাক্টরের ব্যবহার করিয়েছেন। তার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচার করে মানুষকে সচেতন করে তুলেছেন। ছাদকৃষির জনক বলা যায় তাকে। গ্রামে যে পোলট্টি খামার গড়ে উঠেছে। পুকুরে মাছের চাষ বেড়েছে এসবই শাইখ সিরাজের কল্যানে। এখন আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ সম্পন্ন হয়। কৃষকের মার্কেটিং বলে তো আসলে কিছু নেই। বড় বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দখলে নিয়েছে কৃষকের বাজার। আমরা তাকিয়ে দেখি ভাগ্য বিড়ম্বিত কৃষক সবখানে অবহেলিত। শাইখ সিরাজ চেষ্টা করছেন কৃষককে কিভাবে বড় মার্কেটে প্রবেশ করানো যায়। কৃষকের ভাগ্য কিভাবে উন্নয়ন করা যায়। তিনি প্রাণপনে চেষ্টা করে যাচ্ছেন মাঝের যে সুবিধাভোগী আছে সেটাকে ভেঙে দিয়ে সরাসরি কৃষকের কাছে যাতে ভোক্তাকে পৌঁছানো যায়। কৃষকের জন্য এই সংগ্রাম আমরা আমাদের সময়ে একমাত্র শাইখ সিরাজের কাছে দেখেছি। তিনি বড় মাপের একজন উপস্থাপক। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। তিনি চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান এবং পরিচালক। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি আসলে কৃষকের বন্ধু। কৃষি ও কৃষকের তিনি একজন মিত্র। তাকে কৃষি সম্প্রসারক বলতে পারি।
আমরা দেখেছি শীত নেই গ্রীস্ম নেই তিনি ছুটেছেন গ্রামের কোনো মেঠোপথে। শীতের কুয়াশা ভেজা সকালে হয়তো প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো চায়ের দোকানে ছেঁড়া জ্যাকেট পরা কোনো কৃষকের পাশে বসে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। চা পান করতে করতে কৃষকের সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন। কখনো কাঁদামাটিতে প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে নেমে যাচ্ছেন মাটি ও মানুষের এই মানুষটি। তিনি এই মাটিতে নেমে ভাবছেন কিভাবে কোন ফসল এই মাটিতে উৎপাদন হবে। আমরা মনে করি শাইখ সিরাজ একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কৃষি সম্প্রসারক। কৃষির প্রচারে প্রসারে তিনি যে পরিশ্রম করেছেন সেটা ভাবলে আমাদের বিস্মিত হতে হয়। তার ভালোবাসা ধ্যান জ্ঞান সবই কৃষি নিয়ে। শুধু তো শস্য উৎপাদন তাই নয়, হাঁস, মুরগি, পশু পালন, দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদন সব বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে তিনি মাথা ঘামান। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে তিনি কখনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দিকে হাত বাড়াননি। প্রত্যাশাও করেন না। নিজের মতো করে স্বপ্ন দেখেন। সেটা বাস্তবায়নের জন্য জীবন দিয়ে লড়াই করেন। এই যে, ছাদকৃষি নিয়ে মানুষের একটু ভাবনা ছিল। কি হবে। কিভাবে হবে? কিন্তু শাইখ সিরাজ সেই ছাদকৃষিকে এতটাই জনপ্রিয় করেছেন যে এখন দেশের প্রতিটি কোণায় এই ছাদকৃষি পৌঁছে গেছে। শুধু দেশেই নয়, দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের আঙিনায়ও কৃষি এখন জনপ্রিয়। একাই লড়াই করে তিনি ছাদকৃষিকে জনপ্রিয় করেছেন। তিনি বুঝিয়েছেন এবং প্রমাণও করেছেন যে, নগর জীবনে ছাদকৃষি কতটা প্রয়োজনীয়। শহরে নগরে এমন কোনো ছাদ পাওয়া যাবে না যেখানে একটি গাছ নেই। হোক ফুলের গাছ। হোক ফলের গাছ। ড্রোন দিয়ে দেখলে উপর থেকে ঢাকা শহরইে দেখা যাবে সবুজে সবুজে ছেয়ে গেছে। এর কৃতিত্ব একমাত্র শাইখ সিরাজ-এর। ছাদকৃষি এখন অনেক বড় আকারে হয়েছে। তিনি চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান হবার কারণে দেশ বিদেশের নানান সংবাদে চোখ রাখতে হয়। সংবাদকে সাজাতে হয়। কোন সংবাদ কিভাবে প্রচারিত হবে সবই তার নখদর্পনে। এতকিছুর পরও তিনি নায়করাজ রাজ্জাক কিংবা ববিতাকে নিয়ে ডকু ফিল্মও তৈরি করেছেন। সম্প্রতি একটি ডকু ফিল্ম তৈরি করেছেন কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনকে নিয়ে। অসাধারণ মেকিং হয়েছে এটি। সাবিনা ইয়াসমিনের জন্মদিন উপলক্ষে ডকু ফিল্মটি চ্যানেল আইতে প্রচারিত হবে। তিনি যে কাজই করেন গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে করে থাকেন। সেখানে কোনো খুঁত খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঘামে গন্ধে তিনি মাটি ও মানুষের সাথে মিশে যান। কৃষকের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা সবকিছুর সঙ্গে তিনি মিশে থাকেন। কোথাও কোনো অসঙ্গতি দেখলে সেখানেই ছুটে যান তিনি। ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেটার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি লড়াই করে যান।
শাইখ সিরাজের কৃষি জীবনের চল্লিশ বছরের দিকে যদি তাকাই তাহলে আমরা প্রতি মুহূর্তে বিস্মিত হই। নিত্য নতুন পরিকল্পনা, বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যত নিয়েই তার কাজ। সংবাদের পেছনে ছুটে বেড়িয়েছেন। সরকারকে নিত্য নতুন পরিকল্পনা দিয়েছেন। কৃষি উন্নয়নের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। কৃষির হেন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি। কৃষি নিয়ে দক্ষিণ এশিয়াতে তার মতো আর কেউ কাজ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। জীবনের কোনো মোহ তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। এরকম সাধক শ্রেণির মানুষ আমাদের সমাজে আছে কি?
শাইখ সিরাজের বাল্যবন্ধু ফরিদুর রেজা সাগর। বলতে গেলে হরিহর আত্মা। দুজনে এক ও অভিন্ন। একই সঙ্গে বড় হয়েছেন। টেলিভিশনের করিডোরে, রেডিওতে অনুষ্ঠান করতে করতে। ব্যবসা করছেন একসঙ্গে। ঘুরে বেড়িয়েছেন একসাথে। যেকোনো কাজ বা নতুন স্বপ্নও দেখেছেন একসাথে। এই দুজনের বন্ধুত্বের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তারা কর্ম শুরু করেছিলেন পরে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের কর্ণধার হন।
শাইখ সিরাজ সম্পর্কে একবার ফরিদুর রেজা সাগর বলেছিলেন-যদি শাইখ সিরাজকে দুটি বিমান টিকিট দেয়া হয়, একটি ফিনল্যান্ড-এর আরেকটি ফরিদপুরের। তিনি ফরিদপুরকে বেছে নিবেন। গল্পটা এই কারণে বলেছিলেন যে শাইখ সিরাজ এমনই একজন মানুষ যিনি মাটি ও মানুষের সাথে থাকতে ভালোবাসেন। দেশিয় পণ্যের প্রতি তার যে টান ভালোবাসা সেটা বোঝাতেই এই গল্পটি বলেছেন। পাঁচ তারকা হোটেল থেকে শুরু করে টং ঘরের ভাত যে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের সেটা শাইখ সিরাজ-এর চেয়ে আর কে বলতে পারবে?
শাইখ সিরাজের ব্যক্তি জীবনও খুব ছিমছাম। দুই ছেলে অয়ন আর বিজয়। দুজনেই খুব মেধাবী। মিসেস শাইখ সিরাজ গৃহবধূ হলেও তিনি শাইখ সিরাজের সকল কর্মে তার প্রবাব অনস্বীকার্য। শাইখ সিরাজ গুলশান বনানী না থেকে খিলগাঁয়ে পৈতৃক বাড়িতে বসবাস করেন। শুধু নিজের পরিবারই নয় ভাইবোন সহ যৌথ পরিবারের এখনো বাসবাস করেন। তিনি পুরো দেশটাকেই তার পরিবার ভাবেন।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একদিন কথা প্রসঙ্গে বললেন, শাইখ সিরাজ একজন আশ্চর্যরকম টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। টেলিভিশন সবসময় রঙিন ঝলমলে জিনিসকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু সিরাজ কৃষির মতো গম্ভীর সাদামাটা একটি বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠান করে যে জনপ্রিয় হয়েছে তা টেলিভিশন ইতিহাসে বিরল। সিরাজ তার কাজের প্রকৃত মূল্য এখনো পায়নি। তার কাজ নিয়ে গবেষণা করা উচিৎ।
আমরাও স্যারের সাথে একমত। শাইখ সিরাজ যে কাজ করেছেন তার সঠিক মূল্য পাননি। শাইখ সিরাজের কর্ম যদি গভীরভাবে উপলব্ধি করা না যায় তাহলে তার মূল্য দেয়া যাবে না। কৃষি বিষয়টি এমনই মৌলিক যা সাধারণ মানুষের পক্ষে এর ভেদ বোঝা কঠিন। শাইখ সিরাজের কাছে আমাদের শিক্ষার অনেক কিছু আছে। আমরা শাইখ সিরাজের অনুসারী। আমরা শাইখ সিরাজকে নিয়ে গর্ব করি।
মৃত্তিকাসম এই মানুষটির জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা এবং শ্রদ্ধা।
প্রসঙ্গত: শাইখ সিরাজ ১৯৫৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন চাঁদপুরে। শাইখ সিরাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনেই সম্পৃক্ত হন বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতার ও সংবাদপত্রের সঙ্গে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সকল শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন তিনি। পরে চ্যানেল আইতে শুরু করেন কৃষি কার্যক্রম হৃদয়ে মাটি ও মানুষ। উন্নয়ন সাংবাদিকতার জন্য তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দুটি রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৮) এবং একুশে পদক (১৯৯৫) লাভ করেন।
লেখক: শিশু সাহিত্যিক