বুধবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২ আশ্বিন ১৪৩২
 
শিরোনাম:


মতামত
জলবায়ুর খামখেয়ালি স্রোতে পথ হারাচ্ছে ইলিশ
প্রকাশ: বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৫:৩২ পিএম   (ভিজিট : ৪৭)

বাংলাদেশের জলজ সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশের সম্পর্ক প্রাচীন ও অবিচ্ছেদ্য। পদ্মা-মেঘনার রুপালি ঝাঁক শুধু মাছ নয়, এটি বাঙালির পরিচয়ের অংশ, গৌরবের প্রতীক। বর্ষার ভরা নদীতে নৌকার পাশে ভেসে ওঠা রুপালি ঝিলিক মানেই উৎসব। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই মাছ বাঙালির আহার, সংস্কৃতি, এমনকি সাহিত্যের অংশ হয়ে আছে। কবিতা, গান, প্রবাদ—সবখানেই ইলিশের উপস্থিতি। কিন্তু আজ সেই ইলিশ যেন ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইলিশ মাছের প্রজননের ওপর ইতিমধ্যেই গভীরভাবে পড়ছে। ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ এবং এর জীবনচক্র সরাসরি নির্ভর করে নদীর পানির প্রবাহ, তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক চক্রের ওপর। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই স্বাভাবিক প্রজনন-পরিবেশে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটছে।

ইলিশ সাধারণত বর্ষাকালে মিঠা পানির নদীতে ডিম ছাড়ে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের ধরণ বদলে গেছে—কোথাও অতিরিক্ত বৃষ্টি, কোথাও আবার খরা। ফলে নদীর স্বাভাবিক পানির প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। একইসাথে পানির তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে ইলিশের প্রজনন-উপযোগী পরিবেশ নষ্ট করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা অনেক বেড়ে গেছে। ইলিশ সাধারণত স্বল্প লবণাক্ত পানিতে প্রজনন করে। কিন্তু লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় তাদের প্রজননক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে।

ইলিশের ডিম এবং পোনা খুব সংবেদনশীল। পানির তাপমাত্রা বা লবণাক্ততার সামান্য পরিবর্তনেও সেগুলো বেঁচে থাকতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হঠাৎ বন্যা বা পানির স্তর দ্রুত কমে যাওয়ায় বহু ডিম ও পোনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদী ভরাট, ভাঙন এবং নাব্যতা কমে যাওয়ায় ইলিশের প্রজননস্থল ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। ফলে তারা উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছে না ডিম ছাড়ার জন্য। ইলিশ মাছ প্ল্যাংকটন খেয়ে বাঁচে। কিন্তু পানির রাসায়নিক গঠন ও তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে প্ল্যাংকটনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এতে ইলিশ পর্যাপ্ত খাদ্য পাচ্ছে না, ফলে তাদের বংশবিস্তারও ব্যাহত হচ্ছে। সব মিলিয়ে, জলবায়ু পরিবর্তন ইলিশের প্রজনন-চক্রকে অস্বাভাবিক করে তুলছে। এর ফলে উৎপাদন কমছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি, মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা এবং আমাদের খাদ্যসংস্কৃতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলছে।

কেবল জলবায়ুর পরিবর্তন নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাজারনীতি, রপ্তানি চাপ, জাটকা নিধন ও নদ-নদীর অব্যবস্থাপনা। সব মিলিয়ে আজকের বাস্তবতায় ইলিশ আর সাধারণ মানুষের থালার খাবার নয়, বরং বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত হয়েছে। তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ কিনতে গেলে নব্বই শতাংশ মানুষই হাঁসফাঁস করেন। অথচ এই মাছের উৎপাদনে জেলেদের আলাদা খরচ নেই; প্রকৃতি নিজেই ইলিশকে জন্ম দেয়। কিন্তু এর শিকার প্রক্রিয়া ব্যায়বহুল এবং মাছটি চাহিদা সম্পন্ন হওয়ায় এর উচ্চমূল্য কোনভাবেই মানুষের কেনার সামর্থ্যের মধ্যে রাখা যাচ্ছে না।

জাতিসংঘ ও বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার সামুদ্রিক ও মোহনা অঞ্চলে উষ্ণায়নের প্রভাব ভয়াবহ। বাংলাদেশের নদ-নদী আর সমুদ্রের পানি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, যার ফলে ইলিশর স্বাভাবিক জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে। এ কারনে এর উৎপাদনও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এক সময়ে রাজশাহীর পদ্মা নদী পর্যন্ত ইলিশ পাওয়া যেত। যা এখন চাঁদপুর মোহনা ছেড়ে উপরের অংশে খুব কম পাওয়া যাচ্ছে। ফলে এখন আর পদ্মা সে অর্থে ইলিশ মাছ ধরতে কোনো জেলে দেখা যাচ্ছে না। তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর মাওয়ায় গিয়ে পদ্মার ইলিশ খাওয়ার যে ট্রেন্ড চালু হয়েছে তার পুরোটাই ধোকা। কারন, এখানে যেমন কোন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। তেমনি হোটেলগুলোতেও তাজা ইলিশের পরিবর্তে বরফজাত ইলিশ বিক্রি করে থাকে। যা শুধু্ এ অঞ্চলের নয়, বরং চট্টগ্রামের কিংবা বার্মিজ ইলিশ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

ইলিশ মাছ মূলত মিঠা পানি ও নোনাপানির মিশ্র অঞ্চলে প্রজনন করে। কিন্তু নদীতে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এবং তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ডিম ছাড়ার জায়গা কমছে। মেঘনা মোহনা, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর—যেখানে একসময় কোটি কোটি জাটকা বেড়ে উঠত, আজ সেই নদীতে মাছের ঝাঁক কমে এসেছে ব্যাপকভাবে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের শুরুর দিকে যেখানে বছরে গড়ে প্রায় চার লাখ টন ইলিশ আহরিত হতো, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই লাখ টনের ঘরে। জাটকা ধ্বংস ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উৎপাদনের এই ধারা নিম্নগামী হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর আশ্বিন মাসে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর উদ্দেশ্য হলো ডিম ছাড়ার সময় মা ইলিশকে সুরক্ষা দেওয়া। জেলেদের জন্য ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় চাল দেওয়া হয়, কখনও কখনও নগদ অর্থও বিতরণ করা হয়।
কিন্তু মাঠপর্যায়ে দেখা যায়, প্রণোদনা সবার কাছে পৌঁছায় না। অনেক সময় তালিকা তৈরির অনিয়মে প্রকৃত জেলেরা বাদ পড়ে যান, আর সুবিধাভোগী হন অন্যরা। এ কারণে বহু জেলে নিরুপায় হয়ে নিষেধাজ্ঞার সময়েও গোপনে মাছ ধরে। এতে ইলিশের প্রজনন নিরাপদ থাকে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে সংকট আরও তীব্র হয়।

বাংলাদেশে মাছ কেনা মানেই পুরো মাছ কিনতে হবে। মাংস যেমন কেজি দরে বিক্রি হয়, মাছ তেমনভাবে টুকরো করে বিক্রি করার প্রচলন নেই। ফলে কেউ ইলিশ খেতে চাইলে তাকে পুরো একটি কিনতেই হয়। এক কেজির ইলিশ কিনতে গেলে দিতে হয় তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। একটি পরিবারের মাসিক আয় যদি ১৫-২০ হাজার টাকার মতো হয়, তবে তাদের পক্ষে ইলিশ কেনা প্রায় অসম্ভব।
অন্যদিকে, কলকাতা বা ভারতের অন্য শহরের বাজারে ইলিশ বিক্রি হয় টুকরো করে। সেখানকার ক্রেতা চাইলে এক-দুটি পিস কিনতে পারেন। অথচ বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এই নিয়ম চালু হয়নি। ফলে মধ্যবিত্তের ইলিশ খাওয়ার স্বপ্নও অধরাই থেকে যায়। অথচ উন্নত বিশ্বগুলোর সুপারসশগুলোতে প্রয়োজন অনুযায়ী ১/২ পিস মাছ, মাংস কেনার প্রচলন আছে। আমাদের দেশে বিষয়টি যেমন সামাজিকভাবে লজ্জ্বার মনে করা হয় তেমনি দোকানিরাও অধিক বিক্রির আশায় এই পদ্ধতিতে বিক্রি করা থেকে বিরত থাকে।
বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রচুর ইলিশ ভারতে রপ্তানি করে। দুর্গাপূজা কিংবা বিশেষ উৎসবের আগে ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশি ইলিশের চাহিদা আকাশছোঁয়া। কলকাতার বাজারে দেড়-দুই কেজি ওজনের একটি ইলিশ বিক্রি হয় দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায়। অথচ সেই মাছ বাংলাদেশে কিনতে গেলে দাম দাঁড়ায় দ্বিগুণেরও বেশি। রফতানির ক্ষেত্রে কম দামে বিক্রি করার এই প্রবণতাকে অনেকটা নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ফল বলে প্রচার করা হয় কোন কোন মহল থেকে। অন্তবর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়ার আগে যারা এই সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন তাদের অনেকেই ভারতে ইলিশ রফতানির বিরোধিতা করেছিলেন। কেউ কেউ দাদাদের ইলিশ দেয়া হবে না ঘোষণা দিলেও সে কথা রাখতে পারেননি।
এখানেই তৈরি হয় এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। বাংলাদেশে উৎপন্ন মাছ দেশের সাধারণ মানুষ কিনতে পারে না, কিন্তু প্রতিবেশী দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের পাতে অনায়াসে পৌঁছে যায়। কলকাতার বাজারে দোকানিরা হাঁক ছেড়ে যখন পদ্মার ইলিশ বিক্রি করে তখন বাংলাদেশের মানুষের তা দেখা ছাড়া কিছু করার থাকে না।

ইলিশ শুধু খাবার নয়, বাঙালির উৎসবেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্ষার দিনে গরম ভাতের সঙ্গে ইলিশ ভাজা, পান্তা-ইলিশ দিয়ে নববর্ষ উদযাপন, সরষে ইলিশের পদ—এসব বাঙালির সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ আজ নব্বই শতাংশ মানুষ ইলিশ কেনার ক্ষমতা হারিয়েছেন। একসময় যেটি ছিল সাধারণের খাবার, এখন সেটি ধনীদের একচেটিয়া সম্পদে পরিণত হয়েছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক সংকটও। কারণ খাবারের মাধ্যমেই তো সংস্কৃতি বেঁচে থাকে। ইলিশ যদি সাধারণ মানুষের পাতে আর না ফেরে, তবে একসময় বাঙালির ঐতিহ্যও সংকটে পড়বে।

আমাদের ঐতিহ্য আর জাতীয় মাছ ইলিশকে বাঁচাতে হলে কয়েকটি বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।  আমাদের নদ-নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে খনন, দখল উচ্ছেদ ও দূষণমুক্ত রাখতে হবে, জাটকা রক্ষায় আরো কড়া নজরদারি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে জাটকা নিধন ঠেকাতে হবে। জেলেদের হাতে সঠিক সময়ে সহায়তা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়াকে সহজতর করে উন্নত বিশ্ব এমনকি পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতার আদলে  টুকরো করে ইলিশ বিক্রির ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষও অন্তত একবার স্বাদ নিতে পারে। দেশের বাজার সুরক্ষিত রেখে তবেই রপ্তানির অনুমতি দেওয়া উচিত।

ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ, গর্বের প্রতীক। একসময় এটি ছিল সহজলভ্য, এখন হয়ে উঠেছে দুর্লভ। নদীর বুকে যে মাছ ঝাঁক বেঁধে ছুটত, আজ সেটি বাজারে দাঁড়িয়ে সোনার দরে বিক্রি হয়। সাধারণ মানুষের পাতে ইলিশ ফেরাতে হলে শুধু সরকারি উদ্যোগ নয়, দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা, সচেতনতা এবং সামাজিক সদিচ্ছা। নইলে আগামী প্রজন্ম হয়তো বইয়ের পাতায় বা স্মৃতিচারণে ইলিশের গল্প শুনবে, কিন্তু আসল স্বাদ আর পাবে না।

লেখক: এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট, সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট চেইঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম







আরও খবর


 সর্বশেষ সংবাদ

দুর্গাপূজা উপলক্ষে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও প্রতিরোধের আহ্বান দিলেন তারেক রহমান
রাজাকারের নাতিপুতি বলে শিক্ষার্থীদের ট্যাগ দেওয়া ছিল অমর্যাদাকর
আসন্ন নির্বাচনে হাসিনাসহ শেখ পরিবারের সদস্যরা ভোট দিতে পারবেন না
ত্রিশাল মহিলা ডিগ্রী কলেজে নবীন-বরণ
কালিয়াকৈরে দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং লিডার পিচ্চি আকাশ গ্রেফতার
আরো খবর ⇒


 সর্বাধিক পঠিত

কালীগঞ্জে নিখোঁজ ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার
আমার পছন্দ দেশি ছেলে: সেমন্তী সৌমি
বিদেশি গোয়েন্দা পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার এনায়েত
নেতানিয়াহুর বাসভবনের সামনে জিম্মিদের পরিবারের বিক্ষোভ
অ্যাসোসিয়েশন অফ ডেন্টাল এনাটমির কমিটি ঘোষণা
প্রকাশক: এম এন এইচ বুলু
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মাহফুজুর রহমান রিমন  |   উপদেষ্টা সম্পাদক : রাজু আলীম  
বিএনএস সংবাদ প্রতিদিন লি. এর পক্ষে প্রকাশক এম এন এইচ বুলু কর্তৃক ৪০ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, বুলু ওশেন টাওয়ার, (১০তলা), বনানী, ঢাকা ১২১৩ থেকে প্রকাশিত ও শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
ফোন:০২৯৮২০০১৯-২০ ফ্যাক্স: ০২-৯৮২০০১৬ ই-মেইল: spnewsdesh@gmail.com