কুড়িগ্রাম জেলার ফুটবল মানেই এখন এক নাম—জালাল হোসেন লাইজু। যিনি দীর্ঘদিন ধরে নিজের শ্রম, মেধা ও অর্থ ব্যয় করে গড়ে তুলেছেন অসংখ্য খেলোয়াড়, একাডেমি এবং ফুটবলের প্রতি ভালোবাসার পরিবেশ। তার দেওয়া জনপ্রিয় স্লোগান “একটি বল, একটি গ্রাম, ফুটবল নগরী কুড়িগ্রাম” আজ তরুণদের জন্য এক প্রেরণার মন্ত্র।
পারিবারিক অনুপ্রেরণায় ফুটবল
১৯৬০ সালের ২৬ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের একটি স্বনামধন্য পরিবারে জন্ম নেন জালাল হোসেন লাইজু। তার বাবা মনির হোসেন ছিলেন জেলার খ্যাতিমান ফুটবলার। ছোট থেকেই বাবার হাত ধরে ঢাকার মাঠে ফুটবল দেখা এবং বড় ভাইয়ের খেলাধুলা-প্রেমী স্বভাব থেকেই তার মধ্যে ফুটবলের প্রতি গভীর অনুরাগ জন্মে।
বিদ্যালয় জীবন থেকেই তিনি কাব, স্কাউট ও রোভার স্কাউটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পড়াশোনা শেষে গার্মেন্টস শিল্পে চাকরি শুরু করলেও ২০১৫ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে ফিরে আসেন প্রিয় শহর কুড়িগ্রামে। এরপর থেকেই তার জীবন পুরোপুরি ফুটবলের জন্য উৎসর্গিত।
ফুটবল বিপ্লবের পথযাত্রী
লাইজুর হাতে গড়ে উঠেছে কুড়িগ্রাম মোহামেডান ফুটবল একাডেমি, এফসি উত্তরবঙ্গ, জারা গ্রীন ভয়েস কিশোর বাংলা ক্লাব, লাইজু কিডস ফুটবল একাডেমি।
তার বিশ্বাস—“ছোটবেলা থেকে নিয়মিত প্র্যাকটিসে শিশুদের বাজে অভ্যাস জন্মায় না।” তাই তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শিশু ও কিশোরদের একত্র করে ফুটবলের পাঠশালায় যুক্ত করছেন।
তার দেওয়া জনপ্রিয় স্লোগানগুলো তরুণদের মুখে মুখে—
“একটি বল একটি গ্রাম, ফুটবল নগরী কুড়িগ্রাম”
“ঘাসে ঘাসে ফুটবল, গ্রামে গ্রামে গ্রামীণ ফুটবল ফেডারেশন”
“ওয়ান বল, ওয়ান কান্ট্রি”
“রক্তে আমার নর্থ বেঙ্গল”
“ওয়ান বল, ওয়ান ওয়ার্ল্ড”
সাফল্যের ধারা
লাইজুর তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছেন অসংখ্য প্রতিভাবান খেলোয়াড়। বিকেএসপি, বিভিন্ন ক্লাব ও বিদেশে খেলা খেলোয়াড়দের মধ্যে নাহিদ, আকাশ, ছাব্বির বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তিনি প্রশিক্ষক ও টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবেও সাফল্য অর্জন করেছেন—
২০১৬ ও ২০২৫ সালে প্রাইমারি স্কুল ফুটবলে রংপুর বিভাগ চ্যাম্পিয়ন দলের প্রশিক্ষক
২০২৫ সালে কুড়িগ্রাম জেলা দলকে বিভাগীয় রানার্সআপ করা
২০২২ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের অ-১৬ দলের রানার্সআপ ওয়ারীর সহকারী প্রশিক্ষক
২০২৪ সালে ওয়ারী দলের চ্যাম্পিয়নশিপে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর
২০১৯ সালে পাইওনিয়ার লিগে ও ২০২৩-২৪ মৌসুমে তৃতীয় বিভাগে সাফল্য অর্জনকারী এফসি উত্তরবঙ্গের সভাপতি
জারা গ্রীন ভয়েস কিশোর বাংলা ক্লাবের সেক্রেটারি হয়ে দলকে পাইওনিয়ার রানার্সআপ করিয়ে ঢাকা তৃতীয় বিভাগে উন্নীত করা
এছাড়া তিনি বাংলাদেশ ফুটবল সাপোর্টার্স ফোরামের প্রথম সভাপতি, বাংলাদেশ ফুটবল উন্নয়ন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি এবং ক্রীড়া জগত পাঠক ফোরাম, ঢাকা জেলার সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাক্ষাৎকার: সংগ্রাম, অনুপ্রেরণা ও স্বপ্ন
আশির্বাদ রহমান: ফুটবলের প্রতি আপনার আগ্রহ কীভাবে তৈরি হলো?
জালাল হোসেন লাইজু: আমার বাবা ৪০ দশকের ফুটবলার ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাকে ঢাকায় খেলায় নিয়ে যেতেন। বাবার খেলাধুলা ও ম্যানেজমেন্টের অভিজ্ঞতা এবং বড় ভাইয়ের উৎসাহ থেকেই আমার ফুটবলের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।
আশির্বাদ রহমান: খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নের পরিবর্তে খেলোয়াড় তৈরির দিকে ঝুঁকলেন কেন?
জালাল হোসেন লাইজু: আমার ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল—আমি নিজে বড় খেলোয়াড় হব কি না, সেটা নয়। বরং আমার এলাকা থেকে কতজন খেলোয়াড় তৈরি করা যায়, সেই চিন্তাই আমাকে এগিয়ে নিয়েছে। তাই খেলোয়াড় তৈরিই আমার মূল লক্ষ্য।
আশির্বাদ রহমান: কুড়িগ্রামের মতো জেলায় ফুটবল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কী কী চ্যালেঞ্জ এসেছে?
জালাল হোসেন লাইজু: মাঠের অভাব এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা। খেলোয়াড় আছে, প্রতিভা আছে, কিন্তু সুযোগের ঘাটতি। তবে আমি এটাকে সমস্যা হিসেবে দেখি না, বরং আনন্দের জায়গা থেকে কাজ করি। আমার একটাই লক্ষ্য—ফুটবলের মাধ্যমে যেন সারা বিশ্ব কুড়িগ্রামকে চিনে।
আশির্বাদ রহমান: আপনার তত্ত্বাবধানে তৈরি কিছু উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় কারা?
জালাল হোসেন লাইজু: নাহিদ, আকাশ, ছাব্বিরসহ অনেকেই আমার একাডেমি থেকে উঠে এসেছে। তারা বিকেএসপি, বিভিন্ন ক্লাব এবং বিদেশেও খেলেছে।
আশির্বাদ রহমান: জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড় তুলতে আপনার পরিকল্পনা কী?
জালাল হোসেন লাইজু: আমি চাই কুড়িগ্রাম হয়ে উঠুক ফুটবল নগরী। এজন্য “লাইজু কিডস ফুটবল একাডেমি”কে দেশের সুবিধাবঞ্চিত ফুটবলারদের জন্য একটি পাঠশালা হিসেবে গড়ে তুলেছি। ভবিষ্যতে এটিকে আন্তর্জাতিক মানের “বিশ্ব ফুটবল পাঠশালা”তে রূপ দিতে চাই।
আশির্বাদ রহমান: সরকার বা জেলা প্রশাসনের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
জালাল হোসেন লাইজু: সরকারের কাছে আমার বিশেষ কোনো দাবি নেই। তবে তারা যেন আমাদের কাজ জানার চেষ্টা করে, উপদেশ দেয় এবং পরামর্শ দেয়। সহযোগিতা মানেই শুধু অর্থ নয়—সমর্থনই আসল শক্তি।
আশির্বাদ রহমান: ফুটবলের মাধ্যমে সমাজে কী ধরনের পরিবর্তন সম্ভব বলে মনে করেন?
জালাল হোসেন লাইজু: ফুটবল দিয়ে মাদকমুক্ত প্রজন্ম তৈরি করা সম্ভব। কুড়িগ্রাম সীমান্তবর্তী এলাকা, এখানে মাদকের বিস্তার বেশি। কিন্তু ছোটবেলা থেকে যদি বাচ্চাদের খেলাধুলায় যুক্ত করা যায়, তারা খারাপ অভ্যাসে জড়াবে না। ফুটবলই হতে পারে সঠিক পথের দিশা।
ভবিষ্যৎ দৃষ্টি
গ্রামীণ ফুটবলের বিপ্লবী জালাল হোসেন লাইজুর লক্ষ্য স্পষ্ট—কুড়িগ্রামকে ফুটবলের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং বাংলাদেশের ফুটবলকে বিশ্বমানের মঞ্চে পৌঁছে দেওয়া।