প্রকাশ: শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০২৫, ৬:০০ PM
১০ই জুলাই, ২০২৫। ইতিহাস এক নতুন মাইলফলক স্পর্শ করলো। পূর্ণ হলো আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি, এক জীবন্ত কিংবদন্তি ডক্টর মাহাথির মোহাম্মদের জীবনের একশোতম অধ্যায়। ১৯২৫ সালের এই দিনে কেদাহ রাজ্যের আলোর সেতারে জন্ম নেওয়া এই মানুষটির শতবর্ষী জীবন হয়ে উঠেছে একটি জাতির জেগে ওঠার মহাকাব্যিক উপাখ্যান, যার প্রতিটি অধ্যায়ে তিনি ছিলেন প্রধান চরিত্র। তিনি একজন চিকিৎসক থেকে হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা স্থপতি, যিনি একটি সাধারণ কৃষিপ্রধান দেশকে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছেন।
তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল সাধারণ মানুষের খুব কাছ থেকে। মালয়েশিয়া একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র, যেখানে প্রধানত ভূমিপুত্র মালয়, চীনা এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকরা একসাথে বসবাস করে। চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার সময় মাহাথির গভীরভাবে অনুধাবন করেন যে, দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্য সকল জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। এই দর্শন থেকেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেন ভূমিপুত্রদের (Bumiputera) অর্থনৈতিক মুক্তি ও সমৃদ্ধি করণ।
১৯৮১ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি এই নীতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োগ করেন। তাঁর শাসনামলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই ভূমিপুত্র নীতি, যার আওতায় শিক্ষা, ব্যবসা, সরকারি চাকরি এবং সম্পদে মালয়দের জন্য বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তাঁর বিখ্যাত 'পূর্বাভিমুখী নীতি' (Look East Policy) এবং যুগান্তকারী 'ভিশন ২০২০'-এর মতো সকল উন্নয়ন পরিকল্পনার গভীরে এই নীতিটি একটি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
এই বিশাল স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি হাতে নিলেন একের পর এক মেগা প্রকল্প। তাঁর হাত ধরেই মালয়েশিয়ার জাতীয় সক্ষমতা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে আকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, নির্মিত হলো বিশ্বমানের কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (KLIA) এবং দেশকে একসূত্রে বাঁধল নর্থ-সাউথ এক্সপ্রেসওয়ে।
এই যুগান্তকারী উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল এক বিশাল ও নিষ্ঠাবান কর্মশক্তির। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৯৮৩ সালে ডক্টর মাহাথির মোহাম্মদ প্রথম বাংলাদেশ সফর করেন, যা দুই দেশের মধ্যে শ্রমশক্তি রপ্তানির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তাঁর সেই সফরের ফলস্বরূপ, মালয়েশিয়ার অবকাঠামো উন্নয়নের মহাযজ্ঞে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য তৈরি হয় এক বিশাল সুযোগ। মালয়েশিয়ার আকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার কিংবা বিশ্বমানের কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (KLIA)মেট্রোরে এর মতো বিস্ময়কর নির্মাণগুলোর ভিত্তিপ্রস্তরে মিশে আছে অগণিত বাংলাদেশি শ্রমিকের ঘাম ও শ্রম।
তাঁর নেতৃত্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলো দেশের প্রতি তাঁর অটল ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধ। ২২ বছর সফলভাবে দেশ পরিচালনার পর অবসর গ্রহণ করেও তিনি জাতির প্রয়োজনে নীরব থাকতে পারেননি। ২০১৮ সালে ৯২ বছর বয়সে তাঁর বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তন এবং নির্বাচনে জয়লাভ ছিল দেশপ্রেমের এক চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত, যা বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
শতবর্ষ পূর্ণ করে ডক্টর মাহাথির মোহাম্মদ একজনসাবেক সফল রাষ্ট্রনায়ক ও দূরদর্শী রূপকারের প্রতিশব্দ। তাঁর নাম মালয়েশিয়ার অগ্রগতি ও আত্মবিশ্বাসের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। এটা অনস্বীকার্য যে, মালয়েশিয়ার মানচিত্রের প্রতিটি ইঞ্চিতে তাঁর অমোচনীয় ছাপ রয়ে গেছে। তিনি একটি জাতিকে কেবল স্বপ্ন দেখতেই শেখাননি, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথও দেখিয়েছেন—যে পথে হেঁটে বহু বাংলাদেশিও খুঁজে পেয়েছে নিজের ভাগ্য বদলের ঠিকানা।
শুভ জন্মদিন, শতাব্দীর রাষ্ট্রনায়ক। আপনার শতবর্ষী জীবন ও কর্ম আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস হয়ে থাকবে।