জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের আকাশে তখন মৃদু আলো। সালবাউ নীড হলে সেই আলো আরও দীপ্তি পেল দুই বাংলার দুই মহান কবির সৃজন-অগ্নিতে। ২৭ জুন ২০২৫- তারিখটা হয়ে রইল এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাক্ষী। জার্মান বাংলা চ্যানেলের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান- “রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী উৎসব।”ফাতেমা রহমান রুমার উপস্থাপনায়
সেই সন্ধ্যা যেন মেখে নিয়েছিল রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতার নীরবতা আর সুরের ঝংকার। স্বাগত ভাষণে মঞ্চে এলেন জার্মান বাংলা এসোসিয়েশনের দিক-নির্দেশক উপদেষ্টা মুনিব রেজোয়ান। তাঁর কণ্ঠে ভেসে এল শ্রদ্ধা আর গর্বের সুর, যে গর্ব দুই বাংলার সাহিত্যিক ঐতিহ্যের, যে গর্ব রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের জন্মভূমির। অনুভূতির স্রোত বয়ে নিয়ে গেল দেলোয়ার জাহিদ বিপ্লবের কণ্ঠে, যিনি জার্মান বাংলা এসোসিয়েশনের এক্সিকিউটিভ এডিটর।
দূর ইতালি ও অস্ট্রিয়া থেকে আসা অতিথিদের সামনে মঞ্চ আলোকিত করলেন জার্মান বাংলা অ্যাসোসিয়েশনের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি, ডেমোক্রেসি ইনফ্লুয়েন্সার রাফিদ কবির। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ভাবনা-দর্শন নিয়ে তিনি বললেন ইংরেজিতে, যেন বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিলেন দুই কবির প্রাণস্পন্দন।
মঞ্চের আলো বদলে গেল, স্পটলাইট এসে পড়ল ইতালি থেকে আগত সাংবাদিক মাত্রা’র উপর। তিনি বললেন নিজের অনুভূতির কথা-এক প্রবাসীর মনে বাংলা সংস্কৃতির জন্য কত গভীর টান, সেটি যেন ধরা পড়ল তাঁর কণ্ঠের উত্তাপে।
এরপর মঞ্চ দখল করলেন জার্মান ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ফাইন্যান্স কনসালট্যান্ট, “আওয়ার ভয়েস”-এর প্রধান সম্পাদক এবং বন সিটি কাউন্সিলে নির্বাচনে (এসপিডি) পদপ্রার্থী ড. আব্দুল হাই। তাঁর কথা যেন আকাশে তুলল আশা আর আত্মবিশ্বাসের রঙ।
কবিতা যখন মঞ্চে নামে, তখন সময়ও যেন কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায়। কাহ্ন জাতিস্মর আবৃত্তি করলেন রবীন্দ্রনাথের “আমার পৃথিবী।” তাঁর কণ্ঠে কবিতার শব্দগুলো যেন সুর হয়ে মিশে গেল হলরুমের বাতাসে। এরপর মঞ্চে এলেন হাফিজুর রহমান আলম, যিনি কবিতায় ভরিয়ে তুললেন শ্রোতাদের মন।
তবে সন্ধ্যার প্রাণভোমরা হয়ে উঠলেন সঙ্গীতশিল্পীরা। আঁখি হালদার, রবীন্দ্রসঙ্গীতের আন্তর্জাতিক মুখ, তাঁর সুরে মাখিয়ে দিলেন বাঙালির মন। আর ছোটবেলা থেকে নজরুল ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে দীক্ষিত, দুই বাংলায় সুপরিচিত শিল্পী তাপসী রায় তাঁর সুরের ঝংকারে প্রবাসের মঞ্চে ফিরিয়ে আনলেন মাটির গন্ধ, বাংলার মায়া। তাঁদের সুরে সঙ্গত করলেন ফ্রান্স থেকে আগত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তবলা বাদক অনুভব চ্যাটার্জী। তবলার প্রতিটি ঠুক, প্রতিটি ঘূর্ণি যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখল দর্শককে।
দীর্ঘ ২৭ বছর পর ফ্রাঙ্কফুর্টে এমন বিশাল আয়োজন করল জার্মান বাংলা চ্যানেল। প্রবাসীরা বলছেন-এ যেন নিছক অনুষ্ঠান নয়, এ ছিল প্রবাসের বুকে বাংলা সংস্কৃতির এক গৌরবময় মহোৎসব। ফ্রাঙ্কফুর্টের মাটিতে গেয়ে উঠল দুই কবির জয়গান, গেয়ে উঠল বাংলার প্রাণের সুর।
অনুষ্ঠানে ইতালি থেকে আগত সাংবাদিক মাত্রা এবং অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের হাতে সম্মাননা ও উপহারসামগ্রী তুলে দেন জার্মান বাংলা এসোসিয়েশনের সদস্যরা।
মঞ্চের আলো নিভে এলো, শেষ হলো অনুষ্ঠান। কিন্তু দর্শকের মনে রয়ে গেল সেই সুর, সেই কবিতা, সেই প্রেরণা। রাতের প্রিয় প্রহরে পরিবেশিত হলো বাঙালির প্রিয় স্বাদের খাবার। আর তার সঙ্গেই শেষ হলো “রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী উৎসব”-একটি স্মরণীয় প্রবাসী বাংলা সন্ধ্যা।
ফাতেমা রহমান রুমা