বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে আগে থেকেই। কঠোর সাধনা, অধ্যাবসায়, পরিশ্রম, ক্রিকেটের প্রতি আত্মনিবেদন ভালো করার অদম্য বাসনা ও দলের সাফল্যে অবদান রাখার তাগিদ অনুভবে মুশফিকুর রহিম অনন্য।
যে কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেটে অবিচ্ছেদ্য অংশ মুশফিক। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ব্যাটারদের তালিকায় তার নাম আগেই লেখা হয়ে গেছে। টেকনিক, স্কিল, টেম্পারামেন্টেও মুশফিক অনেক বেশি পরিপাটি, সাজানো ও দক্ষ।
ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে তার অর্জন, কৃতিত্বও অনেক। টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটারদের মধ্যে সর্বাধিক রান তার। টেকনিক, স্কিল আর টেম্পরামেন্টের মিশেলে দক্ষ, কুশলী মুশফিক ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও কম সফল নন। ৫০ আর ২০ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের টপ স্কোরারদের তালিকায় মুশফিকের নাম বেশ ওপরের দিকেই আছে।
টেস্টে শুধু রান তোলায় সবার ওপরে থাকাই নয়, বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটার হিসেবে তিন-তিনটি ডাবল সেঞ্চুরি আছে মুশফিকুর রহিমের নামের পাশে। সেই অনন্য মুশফিক এখন এক নতুন এক ইতিহাসের দোরগোড়ায়। তার সামনে আরও এক নতুন মাইলফলক স্থাপনের হাতছানি। কি সেই হাতছানি?
বাংলাদেশের ক্রিকেটে মুশফিক হচ্ছেন প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার, যার সামনে শততম টেস্ট খেলার হাতছানি। আগামী ১৯ নভেম্বর মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে চলতি সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ ম্যাচটিই হবে মুশফিকের ১০০ নম্বর টেস্ট।
সিলেটে বাংলাদেশের ইনিংস বিজয়ের টেস্ট ম্যাচটি ছিল তার ৯৯ নম্বর। ঢাকার মিরপুরের টেস্ট ম্যাচটি হবে শততম। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই ২০০০ সালের নভেম্বর থেকে টেস্ট খেললেও বাংলাদেশেন কোনো ক্রিকেটার এখন পর্যন্ত ১০০ টেস্ট খেলার গৌরব অর্জন করতে পারেননি। কেউ শততম টেস্ট খেলার সম্ভাবনাও জাগাতে পারেননি। এমনকি মুশফিকের তিন সমবয়সী ও সমসাময়িক তামিম ইকবাল (৭১), সাকিব আল হাসান (৭০) ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের (৫০) কেউ ১০০ টেস্ট বহুদুরে ৭৫-এর ঘরও পার হতে পারেননি। দ্বিতীয় সর্বাধিক ৭৪ টেস্ট খেলেছেন মুমিনুল হক।
কথায় বলে ‘ফরচুন ফেবার দ্য ব্রেভ।’ সাহসী যোদ্ধাদের নাকি ভাগ্যও সহায়তা করে। অদম্য আকাঙ্ক্ষা, ভালো করার স্পৃহা ও কঠোর পরিশ্রম পুঁজি করে দেশের বাকি টেস্ট ক্রিকেটারদের কাছে অধরা কৃতিত্বটি ছোঁয়ার ক্ষেত্রে মুশফিকও পাচ্ছেন ভাগ্যের সহায়তাও।
তিনি তার টেস্ট ক্যারিয়ারের শততম টেস্ট খেলতে যাচ্ছেন দেশের মাটিতেই; মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে। এদিকে আগামী ১৯ নভেম্বর থেকে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে শুরু হতে যাওয়া সেই টেস্ট ম্যাচটিক স্মরণীয় করে রাখার একটা সুবর্ণ সুযোগও হাতছানি দিচ্ছে মুশফিককে।
টেস্ট ক্রিকেটের সুদীর্ঘ ইতিহাসে ১০০ বা তার বেশি টেস্ট খেলা ক্রিকেটার আছেন সব মিলিয়ে ৮৩ জন; কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ১০ জন ক্রিকেটার রয়েছেন, যারা এক বিরল ও দুর্লভ কৃতিত্বের অধিকারী। যারা নিজের শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন।
সেই তালিকায় থাকা ১০ ক্রিকেটার হলেন ইংলান্ডের কলিন ক্রাউড্রে, পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াদাঁদ ও ইনজামাম উল হক, ওয়েস্ট ইন্ডিজের গর্ডন গ্রিনিজ, ইংল্যান্ডের অ্যালেক স্টুয়ার্ট, জো রুট, অস্ট্রেলিয়ার রিকি পন্টিং, ডেভিড ওয়ার্নার, দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ ও হাশিম আমলা।
মুশফিক যদি শেরে বাংলার আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এই ম্যাচে সেঞ্চুরি করতে পারেন, তাহলে শততম টেস্টে ১১ নম্বর সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে লেখা হবে তার নাম। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে গৌরবের সঙ্গে উচ্চারিত হবে তার কৃতিত্ব।
সিলেট টেস্টে মাঠে নামার আগে জাতীয় লিগের শেষ ম্যাচে সেঞ্চুরি করে মুশফিকুর রহিম জানিয়ে দিয়েছেন, দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচে বড় ইনিংস খেলার পর্যাপ্ত ফিটনেস ও সামর্থ্য এখনো আছে তার। তবে আইরিশদের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ৬ প্রতিষ্ঠিত ব্যাটারের মধ্যে একমাত্র মুশফিকই রান পাননি। তার সহযোগী মাহমুদুল হাসান জয় (১৭১), নাজমুল হোসেন শান্ত (১০০), সাদমান ইসলাম (৮০) আর মুমিনুল হক (৮২) ও লিটন দাস (৬০) বড় ইনিংস খেললেও মুশফিক আউট হয়েছেন মাত্র ২৩ রানে।
এখন সাফল্যের স্বর্গ শেরে বাংলায় তার ব্যাট যদি তিন অংকে পৌঁছে, তাহলে মুশফিক হবেন দুলর্ভ কৃতিত্বের একাদশতম অধিকারী, যারা শততম টেস্টকে রাঙিয়েছেন সেঞ্চুরি দিয়ে। বাংলাদেশে প্রথম ও একমাত্র ব্যাটার হিসেবে তো অবশ্যই এই কৃতিত্বের অধিকারী হবেন তিনি।
শেরে বাংলায় শতরান করে মুশফিক কি সেই সাফল্যের হিমালয়ের চূড়ায় আরোহন করতে পারবেন? সেটাই এখন দেখার।
শততম টেস্টের সেঞ্চুরিয়ানরা
১. কলিন ক্রাউড্রে (ইংল্যান্ড): অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৬৮ সালের জুলাইয়ে বার্মিংহামের অ্যাজবাস্টনে ১০৪ রান।
২. জাভেদ মিয়াঁদাদ (পাকিস্তান): ১৯৮৯ সালের ১ ডিসেম্বর ভারতের বিপক্ষে, লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে, ১৪৫ রান।
৩. গর্ডন গ্রিনিজ (ওয়েস্ট ইন্ডিজ): ১৯৯০ সালের ১২ এপ্রিল অ্যান্টিগার সেন্ট জোন্সে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ১৪৯ রান।
৪. অ্যালেক স্টুয়ার্ট (ইংল্যান্ড): ২০০০ সালের ৩ আগস্ট ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে, ১০৫ রান।
৫. ইনজামাম-উল হক (পাকিস্তান): ২০০৫ সালের ২৪ মার্চ বেঙ্গালুরুর এম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে, ভারতের বিপক্ষে ১৮৪ রান।
৬. রিকি পন্টিং (অস্ট্রেলিয়া): ২০০৬ সালের জানুয়ারি সিডনিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২ ইনিংসেই শতরানের (১২০ ও ১৪৩*) দূর্লভ কৃতিত্বের অধিকারি।
৭. গ্রায়েম স্মিথ (দক্ষিণ আফ্রিকা): ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ওভালে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩১ রান।
৮. হাশিম আমলা (দক্ষিণ আফ্রিকা): ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি জোহান্সবার্গের ওয়ান্ডরার্স স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৩৪ রান।
৯. জো রুট (ইংল্যান্ড): ২০২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চিদাম্বরম স্টেডিয়াম চেন্নাইতে ভারতের বিপক্ষে ২১৮ রান।
১০. ডেভিড ওয়ার্নার (অস্ট্রেলিয়া): ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর মেলবোর্নে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, ২০০ রান।