বাংলাদেশ খিউকুশীন কারাতে অ্যাসোসিয়েশন- দেশের ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের তালিকায় ৫৫ নম্বরে জায়গা করে নেওয়া নাম। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাঙের ছাতার মতো জন্ম নেওয়া শেষ অ্যাসোসিয়েশন ছিল এটি। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনিকে সভাপতি করে ক্রীড়া সংগঠক পরিচয় দেওয়া কিছু সুবিধাবাদী লোক এই অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
গত ১৭ জুন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ যে তিনটি অ্যাসোসিয়েশন বিলুপ্ত করে অন্য ফেডারেশনের সাথে একীভূত করে দিয়েছে, তার একটি এই খিউকুশীন। দেশে ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন এখন ৫২টি। খিউকুশীন একীভূত করা হয়েছে বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের সাথে। অন্য দুই অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে ঘুড়িকে একীভূত করা হয়েছে বাংলাদেশ কান্ট্রি গেমস অ্যাসোসিয়েশনের সাথে এবং প্যারা আরচারিকে একীভূত করা হয়েছে বাংলাদেশ আরচারি ফেডারেশনের সাথে।
১৯৭৪ সালে যখন প্রথম জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন প্রনয়ণ করা হয় তখন দেশে ক্রীড়া ফেডারেশন ছিল ২২টি। ২০১৮ সালে পূর্বের আইনটি রহিত করে নতুন আইন প্রনয়ণ করা হয়। ওই বছর ৮ অক্টোবর জাতীয় সংসদে অনুমোদন হওয়া জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন-২০১৮ তে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যা ছিল ৪৮টি। ৪৪ বছরে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন বৃদ্ধি পায় ২৬টি, যার বেশিরভাগই নিবন্ধন পায় আওয়ামী প্রশাসনের হাতে। সেই সংখ্যা পরে বেড়ে হয়েছিল ৫৫। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের ক্রীড়া প্রশাসন তিনটি অন্য ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সাথে একীভূত করায় এখন সংখ্যা ৫২।
ঢালাওভাবে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের নিবন্ধন পাওয়ার জন্য ক্রীড়া সংগঠক নামধারী কিছু সুযোগ-সন্ধানী ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও পরিচয়কে। সে সাথে আমলাদের ব্যবহার করেও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে প্রভাব খাটিয়ে নতুন নতুন অ্যাসোসিয়েশন নিবন্ধন করিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সরকারী দলের মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতারা ফেডারেশনের শীর্ষ পদে ছিলেন। একটি কমিটি গঠণ করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে জমা দিয়ে প্রভাব খাঁটিয়ে নিবন্ধন নেওয়ার পরই তারা ভুলে যেতেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ প্রদত্ত আইন-কানুন ও শর্তাবলী। এমনকি অনেক ফেডারেশন অ্যাসোসিয়েশন তাদের বাৎসিরক আয়-ব্যায়ের অডিট পর্যন্ত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে জমা দেয়নি। সে ধারা এখনো রয়ে গেছে অনেক ফেডারেশনে।
অনেক ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন মন্ত্রী। আর তাদের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের শীর্ষ ব্যক্তি অর্থাৎ চেয়ারম্যান প্রতিমন্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই মন্ত্রীর ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন প্রতিমন্ত্রীর ক্রীড়া পরিষদকে বেশি পাত্তাটাত্তা দিতো না। কারণ, ফেডারেশনের সভাপতির একটি ফোন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যানের খুঁটি নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশিরভাগ ফেডারেশনের সভাপতি এক সার্কুলারে অপসারণ করেছিল। তারপর মন্ত্রণালয় গঠিত সার্চ কমিটির সুপারিশে ধীরে ধীরে সিংহভাগ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনে নতুন সভাপতি নিয়োগ দিয়ে আগের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন অ্যাডহক কমিটি গঠণ করেছে।
সার্চ কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যুব ক্রীড়া মন্ত্রণালয় গত ২৪ জুন ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠণ করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অধিভুক্ত ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন সমূহের গঠনতন্ত্র ও অ্যাফিলিয়েশন প্রাপ্তির বিদ্যমান নীতিমালা যুগপোযোগী করণে সুপারিশ প্রনয়ণ করতে।
‘এত ফেডারেশন-অ্যাসোসিয়েশন কেন?’- এই প্রশ্ন বারাবার উঠলেও নিবন্ধন থেমে থাকেনি। বিগত এক-দেড়যুগে নিবন্ধন পাওয়া অনেক ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন দেশে অপ্রচলিত খেলার। তালিকা বড় হতে হতে এতগুলো ফেডারেশন এখন দেশের ক্রীড়া প্রশাসনের কাঁদে বোঝা হয়েই দাঁড়িয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিবন্ধন পাওয়ার পর সেই ফেডারেশনগুলো যদি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের আইন ও শর্ত মেনে খেলা নিয়েই কাজ করতো তাহলে হয়তো তাদের নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতো না। অনেক ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদম পাচার, যৌন কেলেঙ্কারী, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা ধরণের নেতিবাচক খবর প্রকাশ পেয়েছে গণমাধ্যমে। অপকর্ম করে ফেডারেশন কর্মকর্তার জেল খাটার ঘটনাও আছে।
ফেডারেশনের নিবন্ধন নিয়ে কার্যালয়ও বরাদ্দ নিয়েছে। অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফেডারেশনের কার্যালয় ব্যক্তিগত ব্যবসা ও রাজনৈতিক কাজে ব্যবহারেরও অভিযোগ আছে। এখন রাজনৈতিক আলোচনা কমলেও ব্যবসার কাজে কার্যালয় ব্যবহার থেমে নেই। কর্মকর্তারা অন্য কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, বছর শেষে তারা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়ার সময়ও পান না।
ঘরে খেলা আয়োজন না করলেও ছোট ও অপ্রচলিত খেলাগুলোর বিদেশে সফর থেমে থাকে না। আর্থিক সংকট দেখিয়ে ঘরোয়া প্রতিযোগিতা ঠিকঠাক করতে না পারলেও বিদেশে দল পাঠাতে টাকার সংকুলান ঠিকই করে ফেলেন তারা। বিদেশে দল পাঠালে সেই সফরের বিস্তারিত প্রতিবেদন ক্রীড়া পরিষদে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও বেশিরভাগ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন সে দিকে হাঁটে না।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বারবার ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনকে আয়-ব্যায়ের অডিট দিতে বললেও তাতে কাজ হয় না। এমনকি বরাদ্দ স্থগিত করেও তেমন ফল পায়নি দেশের ক্রীড়ার অভিভাবক প্রতিষ্ঠানটি। বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও এখন পর্যন্ত ১৬টি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন অডিট প্রতিবেদন দাখিল করেনি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সূত্রে জানা গেছে- স্কোয়াশ অ্যান্ড র্যাকেটস, কারাতে, শরীরগঠন, বেসবল-সফটবল, সেপাকটাকরো, কান্ট্রি গেমস, মার্শাল আর্ট, ঘুড়ি (বিলুপ্ত), কিকবক্সিং, আন্তর্জাতিক তায়কোয়ানদো, ব্যুত্থান, সার্ফিং, ইয়োগা, চুকবল, জুজুৎসু ও খিউকুশীন (বিলুপ্ত) রয়েছে অডিট রিপোর্ট জমা না দেওয়ার তালিকায়।
তিনটি ফেডারেশন একীভূত করার পর যে ৫২টি রয়েছে তার মধ্যে অনেকগুলোকে অন্য ফেডারেশনের সাথে একীভূত করার সুযোগ রয়েছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের জন্য যে কমিটি গঠণ করেছে, সেই কমিটির হওয়া সভায় এ বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে বলে জানা গেছে। দেশে ফিজিক্যাল গেমের অনেকগুলো ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। অলিম্পিক ডিসিপ্লিন নয় এমনগুলোকে অন্য ফেডারেশনে একীভূত করা এখন সময়ের দাবি বলেই মনে করছেন ক্রীড়াঙ্গনের অভিজ্ঞ অনেক সংগঠক।
বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুদ্দিন হায়দার (অব.) মনে করেন, দেশের ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যা ২৮ এর মধ্যে কমিয়ে আনা সম্ভব। ‘দেশে অলিম্পিক ডিসিপ্লিন আছে ২৪টি। ক্রিকেট যোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে ২৫টি। এই ২৫টি ফেডারেশন রেখে বাকিগুলোকে কমিয়ে ৩টির মধ্যে একীভূত করা সম্ভব। আমাদের এখানে ফিজিক্যাল গেমসের অনেকগুলো ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন আছে। সেগুলোকে একটি ফেডারেশনের অধীনে নিয়ে আসা উচিত। আর যেগুলো গ্রামীণ খেলার মধ্যে পড়ে সেগুলোকে আরেকটি ফেডারেশনে একীভূত করা যায়। ভারতের মতো দেশে ক্রীড়া ফেডারেশন ৫৬টি। তাদের এতগুলো ফেডারেশন পরিচালনার সামর্থ্য আছে। আমাদের দেশের জন্য এত সংখ্যাক ফেডারেশন ক্রীড়া প্রশাসনের জন্য বোঝা। অলিম্পিকে যে ডিসিপ্লিনগুলো আছে তাদের অনেকগুলোরই ভেন্যু নেই। আবার যাদের ক্ষমতা আছে তারা বিশাল ভেন্যু নিয়ে বসে আছে। এগুলো সমবন্টন করা প্রয়োজন।’
দেশের বর্তমান ৫২ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে (বিওএ) অলিম্পিক ডিসিপ্লিন হিসেবে ‘এ’ ক্যাটাগোরিতে নিবন্ধিত হচ্ছে- আরচারি, অ্যাথলেটিকস, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল, বেসবল-সফটবল, বক্সিং, ক্রিকেট, সাইক্লিং, ফেন্সিং, ফুটবল, গলফ, জিমন্যাস্টিকস, হ্যান্ডবল, হকি, জুডো, রোইং, শ্যুটিং, সাঁতার, টেবিল টেনিস, তায়কোয়ানদো, টেনিস, ভলিবল, ভারোত্তোলন, কুস্তি ও রাগবি।
নন অলিম্পিক গেমস তবে আঞ্চলিক খেলা হিসেবে ‘বি’ ক্যাটাগোরিতে বিওএ নিবন্ধিত ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন হচ্ছে- ব্রিজ, দাবা, কাবাডি, কারাতে, উশু ও রোলার স্কেটিং। ‘সি’ ক্যাটাগরিতে নিবন্ধিত মহিলা ক্রীড়া সংস্থা। বিওএ’র নিবন্ধন নেই বাশাআপ, বিলিয়ার্ড অ্যন্ড স্নুকার, শরীরগঠন, ক্যারম, বধির, খো খো, কিক-বক্সিং, মার্শাল আর্ট, সার্ফিং, জুজুৎসু, থ্রোবল, ব্যুত্থান, কান্ট্রি গেমস, চুকবল, সেপাক টাকরো, ইয়োগা, মাউন্টেনিয়ারিং, আন্তর্জাতিক তায়কোয়ানদো ও ন্যাশনাল প্যারালিম্পিকের।
একীভূতির মাধ্যমে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যা কমালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সেই অর্থ সম্ভাবনাময় খেলাগুলোর পেছনে ব্যয় করতে পারবে বলে মনে করেন অনেক সংগঠক। সে সাথে বিদ্যমান ভেন্যুগুলো বিভিন্ন ফেডারেশনের মধ্যে বন্টন করাটাও সহজ হবে।
যেসব ফেডারেশন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিয়ম-নীতি ও শর্ত মানে না, যারা নিয়মিত খেলাধুলা আয়োজন করে না, কার্যালয়গুলো ব্যক্তিগত ব্যবসা ও রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করে, আয়-ব্যায়ের হিসেব দেয় না, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই সময়। কারণ, এখন আর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে রাজনৈতিক প্রভাব মোকাবিলা করতে হবে না। এখন তো দেশ পরিচলনায় আছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আসা অরাজনৈতিক সরকার।