বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ ২০২৫ ১৩ চৈত্র ১৪৩১
 
শিরোনাম:


ধর্ষণের বিরুদ্ধে উত্তাল দেশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বায়ীত্ব
রাজু আলীম
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১১ মার্চ, ২০২৫, ৬:৫৪ PM

ভ্রষ্টাচারের মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ অপরাধ হচ্ছে ধর্ষণ। মাগুরা শহরতলির নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে  ধর্ষণের শিকার হওয়া আট বছর বয়সী শিশু আছিয়া থেকে শুরু করে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় ছয় বছরের এক শিশু ধর্ষণের ঘটনা বারংবার আমাদের জানান দিচ্ছে যে ভালো নেই এই সমাজ, ভালো নেই আমরা। শিশু থেকে শুরু করে কিশোরী, যুবতী অথবা বৃদ্ধা; কেউই কিন্তু রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষকের হাত থেকে। হাতের কথা যেহেতু এসেই গেল, তাই প্রশ্নও এসে যায় যে ধর্ষকের হাত এতো লম্বা হলো কবে থেকে এবং কিভাবে? আরেকটা বিতর্কিত প্রশ্নও মাথায় আসছে, তা হলো ধর্ষকের হাত কি আইনের হাতের চেয়েও লম্বা? এসব আলাপে আমরা ফিরবো। তার আগে জানার চেষ্টা করবো একজন পুরুষ ঠিক কখন এবং সম্ভাব্য কি কি কারণে ধর্ষনের মতো ভ্রষ্টাচারে লিপ্ত হয়।

মার্কিন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডঃ স্যামুয়েল ডি. স্মিথিম্যান, ১৯৭০-এর দশকে  ৫০ জন ধর্ষক পুরুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে জানতে পেরেছিলেন, এই পুরুষদের বিভিন্ন পটভূমি, সামাজিক অবস্থান এবং অবশ্যই, বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব এবং মানসিকতা ছিল। অবাক করার বিষয় ছিল যে এই ধরনের অপরাধমূলক অপরাধ সম্পর্কে কথা বলার সময় তারা যথেষ্ট উদাসীন ছিলেন।
ধর্ষণের পিছনের উদ্দেশ্যগুলি ভিন্ন এবং পরিমাপ করা কঠিন। তবে, গবেষণায় দেখা গেছে যে ধর্ষকদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
- সহানুভূতির অভাব
- নার্সিসিজম
- মহিলাদের প্রতি শত্রুতার অনুভূতি

মার্কিন টেনেসি রাজ্যের দক্ষিণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের একজন গবেষণা অধ্যাপক বলেছেন যে "যৌন নির্যাতন যৌন তৃপ্তি বা যৌন আগ্রহের বিষয় নয়, বরং ব্যক্তির আধিপত্য বিস্তার বা ক্ষমতা চর্চার বিষয়।"
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নাল সাইকোলজি অব ভায়োলেন্সের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ব্যাখ্যা করেছেন যে টক্সিক ম্যাস্কুল্যিনিটি কীভাবে ধর্ষণ সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে। "ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন নির্যাতনের অনেক অপরাধীই তরুণ পুরুষ," তিনি বলেন। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ সমবয়সীদের মধ্যে সামাজিক মর্যাদা অর্জনের একমাত্র উপায় হল অত্যন্ত যৌন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া, এবং যৌনভাবে সক্রিয় না থাকা প্রায়শই কলঙ্কিত করা হয়। এই বিষয়টি ধর্ষনকে পরোক্ষভাবে উস্কানি দেয়।
ধর্ষকরা প্রায়শই তাদের ভুক্তভোগীদের ধর্ষণ করার কথা অস্বীকার করে এবং প্রায়শই তাদের কর্মকাণ্ডকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে। যারা ধর্ষণ স্বীকার করে তারা প্রায়শই তাদের কৃতকর্মের জন্য অজুহাত খোঁজার চেষ্টা করে।

প্রথমেই এটা প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন যে ধর্ষণ কোনও আচরণগত বা মানসিক ব্যাধি নয়, বরং একটি ফৌজদারি অপরাধ। যদিও কিছু ধর্ষকের মানসিক ব্যাধি থাকতে পারে, তবে এমন কোনও ব্যাধি নেই যা মানুষকে ধর্ষণ করতে বাধ্য করে।
কিছু সংস্কৃতিতে, এমনকি প্রায়শই মিডিয়াতেও, এমন কিছু উপাদান কাজ করে যা পুরুষদেরকে নারীদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নকল পুরুষত্বের প্রচার করে এবং যেসকল পুরুষ খুব বেশি যৌন মিলন করে না অথবা করতে পারে না, তাদের তাচ্ছিল্য করে।
ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে উত্তাল সারাদেশ। বিভিন্নস্থানে মিছিল-সমাবেশ করে ধর্ষক ও নিপীড়কদের কঠোর শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র - আসক এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন নারী। এদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১ টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এর ওয়েবসাইট ও আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গবেষণা প্রতিবেদনে নারী নির্যাতনের নানা তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি, এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণের পর হত্যার দুইটি ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে পাঁচ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীও রয়েছেন।

ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী রয়েছেন। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিন জন কিশোরী ও ১৪ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুই জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে ধর্ষিত হওয়া সবচেয়ে কষ্টকর, ভয়াবহ এবং অবমাননাকর অভিজ্ঞতাগুলির মধ্যে একটি। এটি প্রায় সবসময়ই ভুক্তভোগীর মনে আত্ম-ঘৃণা, আত্ম-দোষ এবং ক্রোধের অনুভূতি জাগায় এবং এটি ট্রমা-পরবর্তী স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) সৃষ্টি করে।

মূলত দুই ধরনের ধর্ষকের দেখা মেলে এই সমাজে। সুযোগসন্ধানী ধর্ষক আছে, যারা যৌন তৃপ্তির জন্য যেকোনো সুযোগ কাজে লাগায়, যেমন মদ্যপানের সময় আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা।
 
আরেক ধরণের ধর্ষক আছে, যার উদ্দেশ্য হল ভুক্তভোগীদের অপমান করা এবং হেয় করা।
প্রতিহিংসাপরায়ণ ধর্ষকের রাগ এবং আগ্রাসন সরাসরি নারীদের প্রতি থাকে। এই ধরণের ধর্ষক বিশ্বাস করে যে তাকে নারীদের উপর যৌন আক্রমণ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে কারণ সে মনে করে যে অতীতে নারীরা তাকে আঘাত করেছে, প্রত্যাখ্যাত করেছে বা অন্যায় করেছে।
যৌন নির্যাতন একটি অমার্জনীয় সহিংসতা এবং একটি ফৌজদারি অপরাধ। দুর্ভাগ্যবশত, সমাজের কলঙ্ক এবং দোষ এড়াতে অনেক ভুক্তভোগী নীরব থাকে, অন্যদিকে তাদের ধর্ষকরা অন্য ভুক্তভোগীকে খুঁজতে থাকে স্বাধীনভাবে।
পুরুষদের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা ছাড়া ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। পুরুষদের মধ্যে যদি ছোটবেলা থেকেই নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দেওয়া এবং তাদের বোঝানো হয়– নারীর সম্মতি ছাড়া কোনো সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য নয়, তাহলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। ‘মাচো সংস্কৃতি’ বা পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদকে চ্যালেঞ্জ এবং পুরুষদের এ বিষয়ে শিক্ষিত করা ধর্ষণ প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে।

বাংলাদেশে ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল। ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। এ ছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব থাকার কারণে তারা শাস্তি এড়াতে সক্ষম হয়। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি অপরাধীদের উৎসাহিত করে এবং সমাজে একটি বার্তা পাঠায়– ধর্ষণ করেও পার পাওয়া সম্ভব। তাই ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও কার্যকর করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন; পুলিশ ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভুক্তভোগীদের জন্য নিরাপদ আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি।
ধর্ষণ প্রতিরোধে কাঠামোগত পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ, তবে এটি ছাড়া কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ধর্ষণ প্রতিরোধে শুধু আইনি ব্যবস্থা বা শাস্তির বিধান যথেষ্ট নয়। বরং সামাজিক মানসিকতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক নীতি, গণমাধ্যমের ভূমিকা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বিত পরিবর্তন প্রয়োজন। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সমাজ গড়ে তুলতে হলে শুধু ধর্ষকদের শাস্তি দিলেই হবে না, বরং ধর্ষণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পথগুলোও চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এটাই ধর্ষণ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর ও স্থায়ী উপায়।
সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাও ধর্ষণ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমাজে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বিনির্মাণে বিশাল প্রভাব ফেলে। যদি এসব প্রতিষ্ঠান নারীর মর্যাদা, লিঙ্গ সমতা ও ধর্ষণবিরোধী বার্তা প্রচার করতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।

লেখক : রাজু আলীম। কবি, সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব।







আরও খবর


 সর্বশেষ সংবাদ

নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অস্পষ্ট: মির্জা ফখরুল
প্রফেসর ড. কুদরত জম্মদিনে মালদ্বীপে ইফতারি বিতরণ
সোনারগাঁয়ে ছিনতাই হওয়া মোবাইল কেনার অভিযোগে যুবক গ্রেফতার, এএসআই শফিকুলের বিরুদ্ধে অর্থ আদায়ের অভিযোগ
শেরপুরে মহান স্বাধীনতা দিবসের পুষ্পস্তবক অর্পণ
শেরপুরের ঐতিহাসিক মাই সাহেবা মসজিদে প্রতিদিন ৬ শতাধিক মানুষ ইফতার করছে
আরো খবর ⇒


 সর্বাধিক পঠিত

"ফিলিস্তিনের জনগণের সঙ্গে সংহতি এবং গাজার উপর ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ"
সোনারগাঁয়ে কিশোরীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে সৌদি প্রবাসী যুবক গ্রেফতার
যুবদলের পরিচয় দিয়ে সিরিয়াল চাঁদাবাজি করা হাফিজ ওরফে ময়লা হাফিজ নামে এক চাঁদাবাজ গ্রেফতার
সার্ক সাংবাদিক ফোরামের উদ্যোগে প্রবাসীদের সম্মানে ইফতার ও দোয়া মাহফিল
সোনারগাঁ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টয়লেটের পাইপ থেকে নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার
প্রকাশক: এম এন এইচ বুলু
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মাহফুজুর রহমান রিমন  |   উপদেষ্টা সম্পাদক : রাজু আলীম  
বিএনএস সংবাদ প্রতিদিন লি. এর পক্ষে প্রকাশক এম এন এইচ বুলু কর্তৃক ৪০ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, বুলু ওশেন টাওয়ার, (১০তলা), বনানী, ঢাকা ১২১৩ থেকে প্রকাশিত ও শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
ফোন:০২৯৮২০০১৯-২০ ফ্যাক্স: ০২-৯৮২০০১৬ ই-মেইল: spnewsdesh@gmail.com