বিশৃঙ্খলা আর তিক্ততার পর ব্রাজিলের বেলেমে এমন এক চুক্তির মধ্য দিয়ে
জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের (কপ৩০) পর্দা নামল, যেখানে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির দায়ের কথা সরাসরি বলাই হল না।
তেল, কয়লা ও গ্যাসের ব্যবহার দ্রুত কমানোর প্রতিশ্রুতি চাওয়া যুক্তরাজ্য, ইইউসহ ৮০টির বেশি দেশকে হতাশায় ফেলে শেষ হল এ সম্মেলনের।
তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের পুরনো অবস্থান ধরে রেখেছে; তাদের ভষ্য, অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার করতে দেওয়া দরকার।
এমন সময়ে এ সম্মেলন হল, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ প্রাক-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্য ব্যর্থ হতে চলেছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
সম্মেলনের চূড়ান্ত বৈঠক হয় শনিবার। সেখানে দেশগুলোকে বিরোধিতার সুযোগ না দেওয়ায় এ আয়োজনের সভাপতিত্ব নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন কলম্বিয়ার একজন প্রতিনিধি।
দেশটির প্রতিনিধি ড্যানিয়েলা দুরান গনজালেস বলেন,বিশ্বে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়, তার ৭৫ শতাংশের বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আসে বলে আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে। সেই কারণে আমরা মনে করি, জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে এখন সেই বাস্তবতা নিয়ে কথা বলা শুরু করার সময় এসেছে।
সম্মেলনের চূড়ান্ত পর্বে ‘স্বেচ্ছাসেবার’ ভিত্তিতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যাবে বলে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেওয়ায় এবারই প্রথম জলবায়ু সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র কোনো প্রতিনিধিদল পাঠায়নি। ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনের তত্ত্বকে ‘ভাঁওতাবাজি’ বলেন।
অভিজ্ঞ মধ্যস্থতাকারী, জার্মানির সাবেক জলবায়ু দূত জেনিফার মরগান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি ‘শূন্যতা’ সৃষ্টি করেছে। দেশটি প্রায়ই ইইউ, যুক্তরাজ্যের মত জোটকে সমর্থন দিত। তিনি বলেন, ১২ ঘণ্টার রাত্রিকালীন আলোচনায় যখন তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো কঠোর অবস্থান নেয়, তার বিপরীতে কেউ না থাকলে এটা কঠিন হয়ে যায়।
কিন্তু অনেক দেশ যে আলোচনা থেকে সরে যায়নি বা অতীতের জলবায়ু চুক্তি থেকে পিছুটান দেয়নি, সেটাকে ‘স্বস্তির বিষয়’ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
অ্যান্টিগা ও বারবুডার জলবায়ু দূত রুলেটা থমাস বলেন, একটি প্রক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে কার্যকর থাকায় আমরা খুশি…যেখানে সব দেশেরই কণ্ঠ শোনা যায়।
চূড়ান্ত বৈঠকে সৌদি আরবের একজন প্রতিনিধি বলেন, নিজস্ব বাস্তবতা ও অর্থনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক দেশেরই নিজেদের মতো পথ তৈরির সুযোগ রাখা উচিত।
অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো অতীতে যেমন জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদ ব্যবহার করেছে, সেই সুযোগ সৌদি আরবের থাকা উচিত বলে দেশটি সম্মেলনে তুলে ধরে।
দুই সপ্তাহের এই সম্মেলন বিশৃঙ্খলায় ভরা ছিল। শৌচাগারের পানি শেষ হওয়া, তীব্র বজ্রঝড়ে সভাস্থল প্লাবিত হওয়া এবং প্রতিনিধিদের গরম ও আর্দ্র কক্ষের ব্যবস্থা করতে অসুবিধা হওয়ার মত সমস্যা দেখা দেয়।
সম্মেলনে প্রায় অর্ধ লাখ নিবন্ধিত প্রতিনিধিকে দুইবার সরাতে হয়েছিল। প্রতিবাদকারী প্রায় ১৫০ জনের একটি দল নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করে সভাস্থলে প্রবেশ করে; তারা ‘আমাদের বন বিক্রির জন্য নয়’ লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করছিলেন।
বৃহস্পতিবার অগ্নিকাণ্ডে ছাদে গর্ত সৃষ্টি হলে অংশগ্রহণকারীরা তাড়াহুড়া করে বাইরে চলে যান।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা সম্মেলনের জন্য বেলেম শহরকে বেছে নিয়েছিলেন, যাতে বিশ্বের দৃষ্টি আমাজন বনের দিকে চলে আসে এবং শহরে আর্থিক প্রবাহ বাড়ে।
দেশটির আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী জীবাশ্ম জ্বালানি চুক্তির ইচ্ছা থাকলেও ব্রাজিলের সমালোচনা রয়েছে আমাজনের মুখে তেল খননের পরিকল্পনার জন্য।
গ্লোবাল উইটনেস নামের ক্যাম্পেইন গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, ব্রাজিলে সামুদ্রিক তেল ও গ্যাস উৎপাদন ২০৩০-এর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাড়তে চলেছে।
জাতীয় পরিস্থিতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব—এই দুই নিরিখে দেশগুলোর প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থ রয়েছে। কিছু দেশ সম্মেলনের ফল নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
ভারত জলবায়ু চুক্তির প্রশংসা করে বলেছে, এ চুক্তি ‘অর্থপূর্ণ’। ৩৯টি ছোট দ্বীপ ও উপকূলীয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী একটি গোষ্ঠী শনিবারের চুক্তিকে ‘অসম্পূর্ণ’ বললেও ‘অগ্রগতির’ দেখার কথা বলেছে।
দরিদ্র দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আরও জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি চেয়েছে।
সিয়েরা লিওনের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী জিওহ আবদুলাই বলেন, একটি অগ্রগতি হয়েছে। যারা অতীতে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করেছে, তাদের জলবায়ু অর্থায়নে যে বিশেষ দায়িত্ব আছে— এখন আরও স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু ৮০টির বেশি দেশের জন্য এ এক হতাশাজনক সমাপ্তি, যারা চুক্তিতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পক্ষে বলে আসছিল যুক্তরাজ্যের জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী এড মিলিব্যান্ড বলেন, আমি আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী চুক্তি চাইছিলাম। ইইউয়ের জলবায়ু কমিশনার ওপকে হোয়েকস্ট্রা সাংবাদিকদের বলেন, আমরা যে আরও বেশি, সব বিষয়ে আরও বেশি কিছু চাই, তা লুকানোর কিছু নেই।
ব্রাজিল আলোচনার সূচনা করেছিল ‘উষ্ণমণ্ডলীয় বন সংক্রান্ত স্থায়ী তহবিল’ নামের একটি আলোচনা দিয়ে, যা দেশগুলোকে উষ্ণমণ্ডলীয় বন রক্ষার জন্য অর্থায়ন করবে। শেষ পর্যন্ত এ উদ্যোগ বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে অন্তত ৬.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে।
৯০টির বেশি দেশ বিশ্বব্যাপী বন উজাড় প্রতিরোধ পরিকল্পনা বা ‘রোডম্যাপ’কে সমর্থন করেছে।