প্রায় ২৪ লক্ষ মানুষের জেলা কুড়িগ্রাম, যার কেন্দ্র শহরটিতে বসবাস প্রায় ১ লক্ষ মানুষের। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান চালক—সহ নানা পেশার এই মানুষগুলোর দৈনন্দিন চলাচল শহরের প্রধান সড়কগুলোর ওপর নির্ভরশীল। তাদের এই যাতায়াত নির্বিঘ্ন রাখতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও রাস্তায় নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জেলা ট্রাফিক পুলিশ। রোদ, শীত, বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাদের কঠোর ভূমিকায় যানজট অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বেহাল সড়ক ও অটোরিকশার মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যা।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতাল, আদালত, সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম বালক উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি গার্লস স্কুল সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন দপ্তরে প্রবেশের মূল কেন্দ্র শাপলা চত্বর। এই শহরের বুক চিরে প্রতিদিন হাজারো মানুষকে চলতে হয়। যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় অটোরিকশা। তথ্যমতে, জেলা শহরের ভেতরে প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার অটোরিকশা চলাচল করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মোটরসাইকেল, বাস, ট্রাক, ভ্যান, সিএনজি, নসিমন, কসিমন সহ অন্যান্য যানবাহন। জেলার মোট ২,২৩৬.৯৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের মধ্যে শহরের আয়তন মাত্র ২৭.০৪ বর্গ কিলোমিটার, ফলে যানবাহনের এই বিপুল চাপ যানজট সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক। এই অস্বাভাবিক যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশকে সর্বদা ব্যস্ত সময় পার করতে হয়।
তবে যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের কঠোর পরিশ্রমের প্রধান বাধা রাস্তার বেহাল দশা। শহরটিতে সড়ক বিভাগের অধীনে প্রায় ২ কিলোমিটার এবং পৌরসভার অধীনে প্রায় ১.৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় থাকায় ট্রাফিক পুলিশকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে।
জেলার সচেতন মহলের একজন শাফি আহমেদ জানান, ট্রাফিক পুলিশ তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় যানজট কমাতে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে অনেক সময় তাদের হিমশিম খেতে হয়, যার জন্য জনসাধারণ অনেক সময় ভুলবশত ট্রাফিক পুলিশকে দোষারোপ করে। তিনি মনে করেন, রাস্তা সংস্কারের দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের নয়, তাই রাস্তা সংস্কারের পক্ষকে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। এতে যানজট কমবে, ট্রাফিক পুলিশের কাজ করতে সুবিধা হবে এবং সাধারণ মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে যাতায়াত করতে পারবে।
অন্যদিকে, বিভিন্ন মহল এই জেলায় অটোরিকশার হার বৃদ্ধিকে যানজট সৃষ্টির ৬০ শতাংশ কারণ হিসেবে মনে করছেন। এই প্রসঙ্গে কুড়িগ্রাম রিকশা ও ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি খলিলুর রহমান শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও বলেন, তারা সবসময় চালকদের শহরের ভেতরে যানজট সৃষ্টি না করার জন্য সচেতন করেন। তিনি আরও বলেন, এই জেলায় কর্মসংস্থানের অভাবে অনেক মানুষ রিকশাকে প্রধান আয়ের উৎস হিসেবে বেছে নিচ্ছে, তাই তিনি প্রশাসনকে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান।
ট্রাফিক পুলিশের সচেতনতামূলক কার্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনা আংশিক কমেছে। তিন আরোহী নিয়ে মোটরসাইকেল চালানো এবং হেলমেটবিহীন মোটরবাইক চালানোর বিষয়ে নিয়মিত মামলার হার বাড়ানো হয়েছে। ট্রাক বাস ড্রাইভার সমিতির আবুল কালাম জানান, ট্রাফিক পুলিশের সচেতনতামূলক কথাবার্তা ও নির্দেশ মেনে চলায় তারা সড়কে চলাচল করতে স্বস্তি বোধ করেন।
সকাল ৯টা বাজতেই স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্ন যাতায়াত নিশ্চিত করতে ট্রাফিক পুলিশ কঠোর অবস্থান নেয়। শাপলা চত্বর, কলেজ মোড়, দাদা মোড় সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে ট্রাফিক পুলিশ শিক্ষার্থীদের যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ করে থাকে। সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আঁখি আক্তার ট্রাফিক পুলিশের এই কার্যক্রমে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, কলেজ টাইমে রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকলেও ট্রাফিক পুলিশের কাজের কারণে তারা নির্ভয়ে কলেজে আসতে পারেন।
কুড়িগ্রামের জ্ঞানীগুণী মানুষের মতে, রাস্তার বেহাল দশাই জেলায় যানজট সৃষ্টির মূল কারণ। খানাখন্দে ভরা রাস্তার সংস্কার করা হলে যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম আরও সহজ হবে। একজন রিকশা চালক বলেন, রুজিরোজগারের আশায় রাস্তায় নামতে হয়। ট্রাফিক পুলিশের আচরণ আমাদের খুব ভালো লাগে। তারা সবসময় আমাদের বুঝায়, কিভাবে চলতে হবে, সিগন্যাল মানতে হবে। আমরা তাদের কথা শুনে চলার চেষ্টা করি।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম সদর ট্রাফিক ইনচার্জ মোঃ মন্জুর হোসেন বলেন, আমরা যানজট নিরসনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাই। কেউ যেনো সড়কে ভোগান্তি পোহাতে না হয় সেইদিকে আমাদের কঠোর অবস্থান। হেলমেটবিহীন মটরসাইকেল, ৩ জন আরোহী নিয়ে চলাচল যেনো না হয়, সেই জন্য মামলার হার বাড়ানো হয়েছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অবৈধ পার্কিং ঠেকাতে নিয়মিত কাজ করা হচ্ছে। শহরকে যানজট মুক্ত রাখতে আমাদের কার্যক্রম সবসময় অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও জানান, একে অপরের সহযোগিতায় যানজট নিরসন করা সম্ভব।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পুলিশ সুপার (এসপি) মোঃ মাহফুজুর রহমান বলেন, শহরকে যানজটমুক্ত রাখার জন্য ট্রাফিক বিভাগ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে, তবে অটোরিকশার মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যা, তাদের যত্রতত্র পার্কিং ও অলস অবস্হান, ও রাস্তাঘাটে কাজ চলমান থাকায় সৃষ্ট সমস্যায় ট্রাফিকের কাজে কিছুটা সমস্যা হলেও ট্রাফিক বিভাগের সফলতা প্রশংসনীয়।