২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে মে-এই সময়টা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে এক অনাকাঙ্খিত যুদ্ধ-সংঘাতের সূত্রপাত হিসেবে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সীমান্ত উত্তেজনা ক্রমেই এমন রূপ নিচ্ছে, যা শুধু দুই দেশের নয়, পুরো উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর শঙ্কা তৈরি করেছে। পাহালগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা, ভারতের পাল্টা বিমান অভিযান, পাকিস্তানের জবাবি গোলাবর্ষণ—সব মিলিয়ে যেন আগুনের ওপর ঘি ঢালার মতো অবস্থা।কাশ্মীর বহুদিন ধরেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই এ অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের মধ্যে তিন-তিনবার যুদ্ধ হয়েছে। ২০২৫ সালের হামলা সেই রক্তাক্ত অতীতের নতুন সংস্করণ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ভারতের পাহালগাম অঞ্চলে পর্যটকবাহী একটি বাসে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। ভারত তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ‘জইশ-ই-মোহাম্মদ’ ও ‘লস্কর-ই-তৈয়্যবা’র দিকে আঙুল তোলে। এরপরই শুরু হয় ভারতের ‘অপারেশন সিন্ধুর’—পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের জঙ্গিঘাঁটিতে বিমান হামলা। পাকিস্তান পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সীমান্তে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে এবং নিজস্ব সামরিক অভিযানে নামে। এই পরিস্থিতিতে মনে প্রশ্ন জাগে—উপমহাদেশ কি নতুন করে যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে?
ভারত ও পাকিস্তান-উভয় দেশই পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী। এমন দুটি রাষ্ট্র যদি সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়, তাহলে তা শুধু সীমিত পরিসরের থাকবে না, বরং একটি আঞ্চলিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে। বিশ্বের সামরিক বিশ্লেষকেরা বারবার এই অঞ্চলের ঝুঁকির কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত স্টিমসন সেন্টারের এক গবেষণায় বলা হয়েছে—‘যদি ভারত-পাকিস্তান পরমাণু সংঘাতে জড়ায়, তাহলে তাৎক্ষণিক মৃত্যু হতে পারে ৫ কোটির বেশি মানুষের।’ ভয়াবহ এই চিত্রই বুঝিয়ে দেয়, সামান্য উত্তেজনাও কেমন দুর্বিষহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
ভারতের ইঙ্গিতপূর্ণ ঘোষণা-ইন্দাস পানি চুক্তি স্থগিত করা হতে পারে। এটি শুধু কূটনৈতিক বার্তাই নয়, একপ্রকার “অদৃশ্য যুদ্ধ” শুরু করার হুমকিস্বরূপ। ইন্দাস চুক্তি (১৯৬০) ছিল একমাত্র সফল দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, যা এত যুদ্ধ-সংঘাতের পরেও কার্যকর ছিল। পাকিস্তানের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এই পানির ওপর নির্ভরশীল। ভারত যদি পানি আটকে দেয় বা সরাসরি চুক্তি বাতিল করে, তাহলে পাকিস্তানে খাদ্য উৎপাদনে ধস নামবে। কোটি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, বাড়বে বেকারত্ব ও সামাজিক অস্থিরতা।
পাকিস্তান বর্তমানে গভীর অর্থনৈতিক সংকটে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৫ বিলিয়ন ডলারে। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানের অর্থনীতি একেবারেই ভেঙে পড়তে পারে। ভারতের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল হলেও সামরিক খরচ, বিদেশি বিনিয়োগে পতন, এবং রাজনৈতিক চাপের কারণে তারাও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়বে। ডলারের বিপরীতে রুপি দুর্বল হয়ে পড়বে, জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়বে। যুদ্ধ কখনোই অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর নয়। যুদ্ধ মানেই উন্নয়ন স্থবির, বাজেট ঘাটতি, কর্মসংস্থানে স্থবিরতা এবং সর্বোপরি—জনগণের দুর্ভোগ।
যখন দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নড়েচড়ে বসে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরব সবাই সংযম ও আলোচনার আহ্বান জানালেও কারও অবস্থান সরাসরি একপক্ষের পক্ষে নয়। চীন পাকিস্তানের ঐতিহ্যগত বন্ধু, তবে অর্থনৈতিক স্বার্থে ভারতে বিনিয়োগও করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চায় না এ অঞ্চলে যুদ্ধ হোক, তবে ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ভারসাম্য রক্ষার কৌশলে কাজে লাগাতে চায়। এই দ্বৈত নীতি দক্ষিণ এশিয়াকে আরও জটিল কূটনৈতিক মঞ্চে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশ সরাসরি এই উত্তেজনার অংশ নয়, তবে এর প্রভাব স্পষ্টভাবে অনুভব করতে হবে। ভারত যদি অভ্যন্তরীণ সংকটে পড়ে, সীমান্ত বা বাণিজ্যনীতি পরিবর্তন করে, তাহলে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি, শ্রমবাজার, এমনকি নিরাপত্তা পরিস্থিতিও পরিবর্তিত হবে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। রেমিট্যান্স কমে যেতে পারে, রপ্তানিতে চাহিদা কমবে। রাজনৈতিকভাবে এই অঞ্চল আরও সংবেদনশীল হয়ে উঠবে। সার্ক, বিমস্টেকসহ আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যুদ্ধ বা উত্তেজনা মানেই আঞ্চলিক সংহতির মৃত্যু।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—এই যুদ্ধ কার জন্য? সাধারণ মানুষ চায় স্থিতিশীলতা, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। তারা চায় না সীমান্তে শিশুর লাশ কিংবা গৃহহীনতার ছবি। রাজনীতিকদের আবেগতাড়িত বক্তব্য বা সাময়িক কৌশল হয়তো নির্বাচনে কাজ দেয়, কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদে জাতিকে বিভ্রান্ত করে। ইতিহাস শিক্ষা দেয়—চূড়ান্ত বিজয় আসে আলোচনার মাধ্যমে, অস্ত্রের মাধ্যমে নয়।
ভারত-পাকিস্তানের এই উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হলো—এই যুদ্ধে আমাদের উল্লাস করার কিছু নেই। যুদ্ধ কারও জন্য আনন্দের বিষয় নয়, বরং মানবিক বিপর্যয়ের অন্য নাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারও ক্ষয়ক্ষতির ছবি দেখে উল্লাস বা বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য করা যেমন অনৈতিক, তেমনি তা কূটনৈতিকভাবে আমাদের দেশের জন্যও বিপজ্জনক হতে পারে।
ঋধপবনড়ড়শ, ণড়ঁঞঁনব বা ডযধঃংঅঢ়ঢ়-এ ছড়ানো বিভ্রান্তিকর বা উসকানিমূলক তথ্য, বিদ্বেষ ছড়ানো পোস্ট, কিংবা কোনো একটি পক্ষকে গালাগালি করে অন্যটিকে উসকানি দেওয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করবে। সবচেয়ে বড় কথা—এই ধরনের উগ্র প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের অবস্থানকে একটি নিরপেক্ষ ও শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। স্মরণ রাখা দরকার, এই সংঘাতের উত্তাপ সরাসরি বাংলাদেশে লাগতে পারে—অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, এমনকি নিরাপত্তাগত দিক থেকেও। তাই এই সময় প্রয়োজন বিবেচনাপূর্ণ আচরণ, সংবেদনশীলতা, এবং দায়িত্বশীল নাগরিকত্ব। শান্তি চাওয়ার ভাষা হোক গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগে ও আমাদের মননে।
মনে রাখতে হবে এই যুদ্ধের অভিঘাত বাংলাদেশে বহুবিধ হতে পারে। প্রথমত, অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বিস্তৃত বাণিজ্যিক সম্পর্ক, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ এবং ট্রানজিট সুবিধা—তা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আমদানি-রপ্তানির শৃঙ্খলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহানি ঘটবে এবং রপ্তানি বাণিজ্যে স্থবিরতা আসবে। দ্বিতীয়ত, শরণার্থী প্রবাহের সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না। অতীতেও যুদ্ধ বা দাঙ্গা পরিস্থিতিতে সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে যদি এমন অবস্থা ফেরে, তবে সীমান্ত এলাকায় মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে এবং সরকারকে সেই চাপ সামলাতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
তৃতীয়ত, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগে সীমান্তে অনুপ্রবেশ, অস্ত্র পাচার, চোরাচালান কিংবা জঙ্গি তৎপরতা বাড়তে পারে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যা আমাদের সমাজে বিভাজন তৈরি করতে পারে। চতুর্থত, কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারত কিংবা পাকিস্তান উভয় পক্ষই বাংলাদেশ থেকে পরোক্ষ সমর্থন প্রত্যাশা করতে পারে। একদিকে কৌশলগত মিত্রতা, অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের অনুভূতি—এই দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা হবে অত্যন্ত জটিল।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য জরুরি হলো একটি নিরপেক্ষ, দূরদর্শী ও প্রস্তুতিমূলক অবস্থান গ্রহণ। পররাষ্ট্রনীতিতে স্পষ্ট বার্তা থাকতে হবে—বাংলাদেশ শান্তি চায়, যুদ্ধ নয়। কারও পক্ষ নেওয়ার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক পরিসরে সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশ আঞ্চলিক শান্তির বার্তা দিতে পারে। বাংলাদেশ চাইলেই সার্ক বা ওআইসির প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে পারে, এমনকি ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সংলাপের ক্ষেত্রেও নিজেকে একজন বিশ্বাসযোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে। দেশের সীমান্ত ও নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রস্তুত রাখতে হবে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে এবং সীমান্ত এলাকায় আগাম সতর্কতা জারি করতে হবে। মানবিক সহায়তা প্রদানের প্রস্তুতিও থাকতে হবে যাতে পরিস্থিতি বিপদজনক রূপ নিলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হবে—-ধৈর্য, সংযম এবং সময়োপযোগী কৌশল। উত্তেজনার ঢেউ যখন আমাদের উপকূলে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনায় ভাসছে, তখন নীতিনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করাই হবে আমাদের শ্রেষ্ঠ কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়। বাংলাদেশকে এমন এক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে, যে শান্তির পক্ষে, মানবতার পক্ষে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার পক্ষে নির্ভরযোগ্য শক্তি। এই নীতিগত দৃঢ়তা ও দূরদর্শী পদক্ষেপই নিশ্চিত করবে-এই উত্তপ্ত সময়ে বাংলাদেশ শুধু নিজেকে নিরাপদ রাখবে না, বরং শান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারবে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি শুধু সীমান্তের নয়, পুরো উপমহাদেশের সংকট। দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এখন দরকার পরিণত মনোভাব, সাহসী শান্তির বার্তা, এবং আলোচনাপূর্ণ সমাধান। যুদ্ধ নয়, কূটনীতি হোক ভবিষ্যতের রূপরেখা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা যদি ধ্বংস, বিভ্রান্তি আর ক্ষোভ রেখে যাই, তাহলে আমরা ইতিহাসে শুধুই এক ব্যর্থ প্রজন্ম হয়ে থাকব। তাই আজকের এই উত্তপ্ত সময়ে সবচেয়ে জরুরি বার্তা—শান্তি চাই, যুদ্ধ নয়।
লেখক: চেয়ারম্যান-আল-রাফি হাসপাতাল লিমিটেড, সাংবাদিক, জীবনমুখী লেখক, কলামিস্ট। www.mirabdulalim.com