
‘সাবিনা
ইয়াসমিন’ মানেই যেন মাইক্রোফোন হাতে গানের কোকিল! বাংলা গানের সঙ্গে
এমনভাবে জড়িয়ে গেছে এই নাম, যা সঙ্গীতপ্রেমী বাঙালির হৃদয়ে যেন সুরের
দ্যুতি ছড়ায়। সাবিনার কথা বলতে গেলে অনেকেই একবাক্যে মেনে নেবেন একটি কথা,
আমাদের গান শোনানোর জন্যই জন্মেছেন তিনি! আজ তিনি পা রাখলেন একাত্তরে!
একবার
এক টেলিভিশন চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে সাবিনার কাছে জানতে চাওয়া হয়, শিল্পী
না হলে কী হতেন আপনি? সাবিনা বলেছিলেন, ‘শিল্পী না হলে শিক্ষকতা করতাম।’
কিন্তু বাংলা গানের শ্রোতামাত্রই জানেন, সাবিনা শিক্ষক হলে এত প্রিয় একজন
শিল্পীকে আর পাওয়া হতো না বাঙালির।
তবে শিক্ষককে যেন অনুসরণ করেন
তার শিক্ষার্থীরা, সেভাবে সাবিনাকেও অনুসরণ করেছেন বহু শিল্পী। বিশেষ করে
অনুজ অনুরাগীরা। এখনো তার অনেক গান নতুন প্রজন্মের শিল্পী কাভার করেন।
বিশেষ করে সঙ্গীত-প্রতিভা খুঁজে বের করার প্রতিযোগিতায়। সাবিনার জনপ্রিয়
গানগুলোই গাইতে শোনা যায় বহু তরুণ শিল্পীকে। অন্যদিকে বিভিন্ন মাধ্যমে আজও
সাবিনার গাওয়া আধুনিক, দেশাত্মবোধক ও সিনেমার গানগুলি বাজতে শোনা যায়।
সাবিনা
ইয়াসমিন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গানের ভুবনে বিচরণ করছেন। বাংলাদেশে
গানে ইতিহাসে তার পাশে দাঁড় করানো যায় এমন শিল্পী নেই। এত লম্বা সময় ধরে
সঙ্গীতে এমন মিষ্টি আধিপত্য ধরে রাখতে পারেননি কেউ। গত কয়েক দশকে তিনি ক
হাজার গান গেয়েছেন তার সঠিক হিসাব আজ আর স্বয়ং শিল্পীর কাছেও নেই। গেয়ে
যাচ্ছেন আজও। মরমী শিল্পী আব্দুল আলীম থেকে শুরু করে এ কালের কোনো উঠতি
তরুণের সঙ্গেও দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছেন সাবিনা।
সাবিনা সুযোগ পেয়েছেন
উপমহাদেশের বরেণ্য সুরকার রাহুল দেব বর্মণের সুরে গান গাওয়ার। কিশোর কুমার
এবং মান্না দের সঙ্গেও দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। সাবিনা
ইয়াসমিন চলচ্চিত্রের গানেই বেশি কণ্ঠ দিয়েছেন। হিসেব করে দেখা গেছে,
চলচ্চিত্রে প্রায় ১২ হাজারের মতো গান করছেন তিনি। সেসব গানের জন্য
একধিকবার জিতেছেন জাতীয় পুরস্কারও।
গানের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক
ঘটনা জমেছে সাবিনা ইয়াসমিনের জীবনে। তার একটি লতার সঙ্গে দেখা! উপমহাদেশের
কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সাবিনার। ১৯৭৮ সালে
বাংলাদেশ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশ নিতে মুম্বাই গিয়েছিলেন তিনি। সেই উৎসবের
ফাঁকে একটি পার্টিতে লতা মঙ্গেশকরের সামনে গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তার। ফিল্ম
ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে বাংলাদেশের শিল্পী দলে ছিলেন ববিতা, রাজ্জাক, রোজী
সামাদ, কাজী জহির প্রমুখ।
ঘটনা স্মরণে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ফিল্ম
ফেস্টিভ্যালের ফাঁকে মুম্বাইয়ের একটা অনুষ্ঠানে গাইছিলাম। কিছুই ছিল না,
শুধু হারমোনিয়াম নিয়ে গাইছিলাম। শচীন দেব বর্মণ বলেছিলেন, ‘মা, তুমি
বাংলাদেশের একটা গান শোনাও।’ বললাম, কী রকম গান। বললেন, ‘মাটির গান,
পল্লিগীতি শোনাও।’ তখন আমি ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা’ গেয়েছিলাম। কোনো
মিউজিশিয়ান ছিল না, হারমোনিয়ামে গেয়েছিলাম। মাথা নিচু করে তিনি শুনছিলেন।
মাথা তুলতেই দেখলাম, তার দুই চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক
আশীর্বাদ করলেন। আরেকটা গান গাইতে শুরু করেছি, দেখি করিডরের দিক থেকে লতাজি
ঢুকছেন! লতাজিকে দেখে হারমোনিয়াম ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যাই। আমাকে তো আর কেউ
খুঁজে পায় না। ভয়ে আমার জীবন শেষ! ওরে বাপ রে বাপ, ওনার সামনে গান গাইব
আমি! তখন তো বয়স আরও কম। উপায়ও নেই। গাইতেই হলো।
সাবিনা ইয়াসমিন
১৯৫৪ সালের আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে জহির রায়হানের ‘আগুন
নিয়ে খেলা’ সিনেমায় আলতাফ মাহমুদের সংগীত পরিচালনায় মাত্র ১৩ বছর বয়সে
প্রথম প্লেব্যাক করেন। এর পর কেবল এগিয়ে গেছেন।
সাবিনা ইয়াসমিনের
গাওয়া শ্রোতাপ্রিয় দেশের গানগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘জন্ম আমার ধন্য হলো’, ‘ও
আমার বাংলা তোর’, ‘একটি বাংলাদেশ’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে’, ‘সব কটা জানালা
খুলে দাও না’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘সেই রেল লাইনের ধারে’ ও
‘যদি মরণের পরে কেউ প্রশ্ন করে’।
তার গাওয়া অন্য জনপ্রিয়
উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে, ‘এ কী সোনার আলোয়’, ‘প্রেম যেন এক গোধুলি
বেলার’, ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয়’, ‘এই পৃথিবীর পরে কত ফুল ফোটে’, ‘মন যদি
ভেঙ্গে যায় যাক’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘এ
আঁধার কখনো যাবে না’, ‘জানি না সে হৃদয়ে কখন এসেছে’, ‘চিঠি দিও প্রতিদিন’,
‘ইশারায় শীষ দিয়ে আমাকে ডেকো না’, ‘এ সুখের নেই কোনো ঠিকানা’।