
শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এক মনোমুগ্ধকর পর্যটন এলাকা হলো গজনী অবকাশ কেন্দ্র। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়ি ছায়া, নির্মল বাতাস আর নিঃসঙ্গ সবুজে ঘেরা এ স্থানটি এখন দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যারা শহরের কোলাহল থেকে একটুখানি শান্তি ও প্রকৃতির সান্নিধ্য খুঁজছেন, তাদের জন্য গজনী এক স্বপ্নের ঠিকানা।
গজনী অবকাশ কেন্দ্রের মূল আকর্ষণ এর প্রাকৃতিক পরিবেশ। চারপাশে বিস্তৃত গারো পাহাড়ের সারি যেন প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো। পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা বনভূমি, বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরাজি আর মাঝে মাঝে বন্যপ্রাণীর চলাচল এ অঞ্চলটিকে করে তুলেছে আরও জীবন্ত। এখানে দাঁড়িয়ে দূরে তাকালে পাহাড়ের ঢেউ খেলানো রেখা আর নীল আকাশের সংযোগরেখা চোখে পড়বে, যা হৃদয়ে এক ধরনের প্রশান্তি এনে দেয়।
এই অবকাশ কেন্দ্রে রয়েছে পর্যটকদের জন্য নির্মিত ছাউনিযুক্ত বিশ্রামাগার, ছোট জলাধার বা কৃত্রিম লেক, ফুলের বাগান, বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য পার্ক এবং পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এই টাওয়ারে উঠে পুরো এলাকা ও পাহাড়ি দৃশ্য একনজরে উপভোগ করা যায়। কৃত্রিম লেকের পাশে বসে কিংবা বাগানে হেঁটে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
গজনী অবকাশ কেন্দ্র শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান নয়, আদিবাসী সংস্কৃতির স্পর্শ পাওয়া যায় এমন স্থানও বটে। এখানে গারো, হাজং, কোচসহ বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস। তারা তাদের নিজস্ব জীবনধারা, পোশাক, খাবার ও উৎসবের মাধ্যমে এ অঞ্চলকে করেছে বৈচিত্র্যময়। ভাগ্য ভালো হলে গারো সম্প্রদায়ের কোনো উৎসব বা নাচ-গান দেখতে পাওয়া যায়, যা ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করে।
জায়গাটি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকে দর্শনার্থীদের জন্য। বিশেষ করে শীতকালে ও ছুটির দিনে এখানে পর্যটকের ভিড় জমে। পরিবার, বন্ধু কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাসফরের জন্য স্থানটি অত্যন্ত উপযোগী।
গজনী ভ্রমণে এসে অনেকেই আশপাশের অন্য পর্যটন স্পট যেমন মধুটিলা ইকো পার্ক বা গারো পাহাড়ের অভ্যন্তরের বিভিন্ন নদ- নদী পর্যন্ত ঘুরে আসেন। যারা প্রকৃতি, নীরবতা এবং শান্ত পরিবেশ খুঁজছেন তাদের জন্য এ অঞ্চল পুরোপুরি উপযুক্ত। এখানে এলে শহুরে জীবনের কৃত্রিমতা ভুলে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়।
গজনী অবকাশ কেন্দ্র শুধু একটি পর্যটন স্পট নয়, এটি প্রকৃতির কোলে এক অনন্য আশ্রয়। স্বল্প খরচে, অল্প সময়ের ভ্রমণ পরিকল্পনায় স্থানটি যে কারও মনের খোরাক জোগাতে সক্ষম। যাদের ব্যস্ত জীবনে একটুখানি প্রশান্তি আর নতুন কিছু দেখার বাসনা রয়েছে, তাদের জন্য গজনী হতে পারে একটি অবিস্মরণীয় গন্তব্য।

যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে গজনী অবকাশ কেন্দ্রে পৌঁছাতে সবচেয়ে সুবিধাজনক হলো সড়কপথ। ঢাকা (মহাখালী, কমলাপুর বা স্টেডিয়াম মার্কেট) থেকে সরাসরি বাসে যাওয়া যায় শেরপুর শহরে। সাধারণভাবে ‘ড্রিমল্যান্ড’ বা ‘স্পেশাল’ বাস ব্যবহার করলে ভাড়া পড়ে প্রায় ৪৫০-৫০০। মহাখালী থেকে দুপুর ২টায় ছাড়ে বাস, আবার গুলিস্তান বা স্টেডিয়াম মার্কেট থেকেও বিকেল ৩-৪টায় শেরপুর যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। যারা ময়মনসিংহ হয়ে যেতে চান, তারা ট্রেনে প্রথম ময়মনসিংহ বা জামালপুর যেতে পারেন। তার পর সেখান থেকে অটোরিকশা ও সিএনজি ভাড়া করে শেরপুর শহরে আসতে পারেন। শেরপুর সদর থেকে গজনী (প্রায় ৩০ কিমি) যাওয়ার রাস্তা একেবারেই মসৃণ পিচঢালা সড়ক, যাতায়াত আরামদায়ক এবং সহজ। শেরপুর থেকে গন্তব্যে পৌঁছাতে গাড়ি দিয়ে সময় লাগে প্রায় ৪০ মিনিট।
স্থানীয় জনগণ সাধারণত শেরপুর থেকে লোকাল বাস, মাইক্রোবাস, টেম্পো, সিএনজি বা অটোরিকশা ব্যবহার করে গজনীতে যান। বাসে ভাড়া সাধারণত ৫০ টাকা, সিএনজি ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা হয়। চাইলে বাসের বদলে প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস ভাড়া করে ঢাকা থেকে সরাসরি গন্তব্যে যেতে পারেন।
সতর্কতা:গজনী অবকাশ কেন্দ্র একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবেষ্টিত ও সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় সেখানে ভ্রমণের সময় কিছু বিষয় বিশেষভাবে খেয়াল রাখা জরুরি। এসব সতর্কতা মেনে চললে আপনার ভ্রমণ হবে নিরাপদ, উপভোগ্য এবং ঝামেলামুক্ত।
প্রথমত, গজনী অবকাশ কেন্দ্র ভারতের মেঘালয় সীমান্তের খুব কাছাকাছি হওয়ায় সীমান্ত আইন ও নিরাপত্তা বিধিনিষেধ মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। ভ্রমণকালে কখনোই বিজিবি কর্তৃক চিহ্নিত সীমানা অতিক্রম করবেন না। অনেক সময় পর্যটকরা ছবি তুলতে গিয়ে বা পাহাড় বেয়ে উঠে ভুলবশত সীমান্তের বাইরে চলে যান, এটি মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে। তাই শিশু ও কিশোর বয়সী পর্যটকদের ওপর নজর রাখা অত্যন্ত জরুরি।
দ্বিতীয়ত, যেহেতু এটি একটি পাহাড়ঘেরা ও বনাঞ্চলসমৃদ্ধ এলাকা, তাই বর্ষাকালে ভ্রমণ করলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বৃষ্টির সময় পাহাড়ি পথ পিচ্ছিল হয়ে পড়ে এবং যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বর্ষায় গেলে ছাতা বা রেইনকোট এবং ভালো গ্রিপযুক্ত জুতা সঙ্গে নেওয়া উচিত। শুকনো মৌসুমে গেলে ধুলোবালি ও গরমের কথা মাথায় রেখে পানির বোতল ও হালকা পোশাক সঙ্গে রাখা বাঞ্ছনীয়।
তৃতীয়ত, গজনীতে আধুনিক চিকিৎসা বা খাবারের সুবিধা সীমিত। তাই যাদের সঙ্গে শিশু, বয়স্ক বা কোনো বিশেষ শারীরিক সমস্যা রয়েছে, তাদের প্রয়োজনীয় ওষুধ ও খাবার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এ ছাড়া দিনে ভ্রমণ শেষ করে সন্ধ্যার আগেই শহরে ফিরে যাওয়াই নিরাপদ, কারণ অন্ধকারে পাহাড়ি এলাকায় যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
সবশেষে, জায়গাটি পরিচ্ছন্ন রাখা সবার দায়িত্ব। অনেক পর্যটক খাবার খেয়ে বর্জ্য ফেলে যান, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। গজনীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা করতে হলে নিজেরা পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার পাশাপাশি অন্যদেরও সচেতন করতে হবে। সঙ্গীদের সঙ্গে উচ্চ শব্দে গান বাজানো বা শব্দদূষণ করাও এড়িয়ে চলা উচিত, বিশেষত যেহেতু এটি একটি প্রাকৃতিক ও শান্ত এলাকা।
সেরা ট্যুর প্যাকেজ:শেরপুর জেলার আরও দর্শনীয় স্থান
শেরপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর একটি অঞ্চল। এখানকার গারো পাহাড়ের বুক চিরে প্রবাহিত ঝিনাই নদী মাহরশী, সোমেশ্বরী, তাছাড়া ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ীর রাবার ড্যাম পর্যটকদের খুবই পছন্দের জায়গা। শেরপুর সদরে অবস্থিত রাণী বিলাসমণি জমিদার বাড়ি, পৌনে তিন আনি জমিদার বাড়ি, বারোদুয়ারী মসজিদ, মাইসাহেবা মসজিদ ও ঘাগরা লস্কর খান মসজিদ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিদর্শন বহন করে। এ ছাড়া সদর উপজেলায় রয়েছে শাহ কামালের মাজার, যা ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে পরিচিত।
শ্রীবরদী উপজেলায় অবস্থিত লাউচাপড়া
ইকো পার্ক ও পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলও দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম গন্তব্য। এখানে এলে পাহাড়ি প্রকৃতি ও পাখির কিচিরমিচির শব্দ মিলিয়ে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। এ ছাড়া ভেলুয়া পাহাড়, গারো আদিবাসী গ্রাম, আলহাজ মোর্শেদ হোসেন স্মৃতি জাদুঘর ও ভেলুয়া জলপ্রপাত শেরপুরের কম পরিচিত হলেও মনোমুগ্ধকর দর্শনীয় স্থান হিসেবে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।