
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের লিখিত পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়ার নামে কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর স্টেনোগ্রাফার মো. সেলিমের বিরুদ্ধে। তিনি বার কাউন্সিল সচিবের নাম ব্যবহার করে একাধিক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা নগদ এবং নিজের জন্য ৫০ হাজার টাকা চেক বা নগদ টাকা হাতিয়ে নেন। এ নিয়ে মেধাবী পরীক্ষার্থীদের মাঝে চরম উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখা হাজারো মেধাবী পরীক্ষার্থীর উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এ চাঞ্চল্যকর অভিযোগ।
জানা গেছে, গত ২৮ জুলাই বার কাউন্সিলের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবে। এ প্রেক্ষিতে মো. সেলিম পরীক্ষায় পাশ করানোর নামে অন্তত ৩০ জনের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের বর্তমান সচিব জেলা জজ মোহাম্মদ কামাল হোসেন সিকদার। তিনি পূর্বে কক্সবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তবে তিনি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি অল্প কিছুদিনের মধ্যে বার কাউন্সিলের সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি যে ক' দিন কক্সবাজারে ছিলেন, তখন থেকে স্টেনোগ্রাফার মো. সেলিমের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে সেলিম বলে বেড়ান।
টাকার অঙ্কে 'নিশ্চিত পাস': ঘুষের প্রমাণ কথোপকথনে: গত ২৮ জুলাই অনুষ্ঠিত বার কাউন্সিলের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই স্টেনোগ্রাফার মো. সেলিম অন্তত ৩০ জন পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অর্থ লেনদেনের বিস্তারিত উঠে এসেছে একটি প্রায় ২২ মিনিটের কথোপকথনে।
কথোপকথনে সেলিমকে বলতে শোনা যায়, ''সচিবের জন্য ৩ লাখ টাকা নগদ, আমার জন্য ৫০ হাজার। কাজটা হয়ে যাবে-ইনশাআল্লাহ।” তিনি আরও বলেন, “স্যার রোল নাম্বারগুলো ফলাফল সীটে উঠিয়ে দেবে। এ ছাড়াও আরো যা যা করতে হয়, তা করবে। তা স্যারের জন্য কোনো ব্যাপারই না।”
ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ হিসেবে তিনি পরীক্ষার্থীদেরকে হোয়াটসঅ্যাপে বার কাউন্সিল সচিব জেলা জজ মোহাম্মদ কামাল হোসেন সিকদার-এর সঙ্গে তার মাছ পাঠানোর দৃশ্য ও বার্তা দেখান।
উল্লেখ্য, বর্তমান বার কাউন্সিল সচিব মোহাম্মদ কামাল হোসেন সিকদার পূর্বে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এর বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সুবাধে স্টেনোগ্রাফার সেলিমের সঙ্গে তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেই পরীক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেন যে, তিনি সচিবের মাধ্যমে তাদের ফলাফল নিশ্চিতভাবে পাস করাতে পারবেন।
পরীক্ষার্থী ও আদালত পাড়ার জনশ্রুতি :
জুলাই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ করে বলেন, 'সেলিম সচিবের নাম ভাঙিয়ে অন্তত ৩০ জনের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে নিয়েছে। যদি এক জেলায় ৩০ জন করে নেয়, তাহলে সারা দেশে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়ে গেছে। এভাবে ঘুষ দিয়ে পাস করালে মেধাবীরা ফেল করবে। এটা মেধার প্রতি চরম অন্যায়। দ্রুত তদন্ত ও শাস্তি না হলে বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা থাকবে না।”
জাহাঙ্গীর আলম, কোর্টপাড়ার আইনজীবী ও স্থানীয় সূত্রমতে, সেলিম শুধু জাহাঙ্গীর নন, 'বে... ই... আ...' আদ্যাক্ষরের বহু পরীক্ষার্থীর কাছ থেকেও টাকা নিয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এছাড়া তার যতো মুঠোফোন নাম্বার আছে, সবকিছুর তদন্ত করলে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে বলে দাবি তাদের।
আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া:
এই গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইন অঙ্গনের সংশ্লিষ্টদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এটি ভয়ংকর বিষয় উল্লেখ করে বলেন, ট্রাইব্যুনালটির স্টেনোগ্রাফার বিচারকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। তাই ওনিই ভালো বলতে পারবেন।
ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী সজীব বালা বলেন, এমসিকিউ থেকে একটি চক্র পরীক্ষার্থীদের পাশ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এটর্নি জেনারেলও ৩ শত পরীক্ষার্থীদের পাশ করানোর সুপারিশ আসে বলে লাইভে বলেছিলেন। ওনি ছাড়া অন্যরা সুপারিশ মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু এটর্নি জেনারেল মেনে না নেওয়াতে তা হয়নি। তখন থেকে একটি চক্র অপচেষ্টা করে যাচ্ছে।
বর্তমানে বিভিন্ন এজেন্ট যে টাকার বিনিময়ে পাশের চুক্তি করেছে এটা সবাই জানেন।
তিনি বলেন, পরীক্ষার্থীরা লিখিত খাতা রিভিউ এর সুযোগ পেলে কেউ অন্যায়ের সুযোগ নিতে পারতো না। কিন্তু এ ব্যাপারে কারো মাথা ব্যথা নেই। এ আইনজীবী গত ২০ তারিখ লাইভে এসে এ চক্র নিয়ে কথা বলেন। পরে অবশ্য লাভের ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অপর আইনজীবী মো: শামসুদ্দোহা বলেন, যে তথ্য সমূহ বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে, যা নি:সন্দেহে বার কাউন্সিলের পরীক্ষার্থীদের জন্য হতাশাজনক। বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের উচিত তা সঠিকভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
সচিবের বক্তব্য : বার কাউন্সিল সচিব জেলা জজ মোহাম্মদ কামাল হোসেন সিকদার বলেন, আমি মাত্র এক সপ্তাহ কক্সবাজার ছিলাম। কাজেই ওখানকার কারো সাথে আমার বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ যদি আমার নাম ব্যবহার করে আমি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো। তিনি আরো বলেন, পরীক্ষার ফলাফল দ্রুত ঘোষণা করা হবে। ওখানে যদি কেউ পাশ করে থাকে, সেটা তার যোগ্যতা বলে করবে। এতে টাকার বিনিময়ে পাশ করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি তাকে টাকা দিয়ে থাকে, সেই টাকা যেনো এখনই ফিরিয়ে নেন এবং ভুক্তভোগী হিসেবে তার বিরুদ্ধে ব্যবাস্থা গ্রহণ করবেন বলে সচিবের চাওয়া।
অভিযুক্তের বক্তব্য :
অভিযুক্ত স্টেনোগ্রাফার মো. সেলিম তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, “স্যার (সচিব) খুব ভালো মানুষ, এসব কাজ করেন না। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভুয়া, ভিত্তিহীন এবং আমাকে হেয় করার জন্য একটি চক্রান্ত।”
প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেনের খবর ছড়িয়ে পড়ায় মেধাবী পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র হতাশা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।