
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, সাহস থাকলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ন্যায়বিচারের মুখোমুখি হতেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিন জনের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক খণ্ডনের শেষ দিনে বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তিনি এমন কথা বলেন।
এ দিন শুরুতেই পবিত্র কোরআনের সুরা নিসাসহ দুটি সুরার আয়াতের রেফারেন্স টেনে আনেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, আজ আমি ন্যায়বিচার প্রত্যক্ষ ও সাক্ষী হতে এসেছি। এ মামলায় সব ধরনের দালিলিক-মৌখিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন প্রসিকিউশন পক্ষ। তবে আসামিরা কোনও নির্দেশ দেননি বা বলেননি বলে যুক্তি দেখিয়েছেন স্টেট ডিফেন্স। ভাগ্যিস বলেননি এ দেশে কোনও জুলাই রেভ্যুলেশন হয়নি, কেউ মারা যাননি কিংবা আহত হননি। অথচ বাংলাদেশে ১ হাজার ৪০০ মানুষ মারা গেলেন। এত বড় একটা জুলাই রেভ্যুলেশন হলো। হত্যাকাণ্ড হলো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় স্টেট অ্যাপারেটাস (রাষ্ট্রযন্ত্র) ব্যবহার করে।
তিনি আরও বলেন, বিচার যত কঠিনই হোক যত বাধার প্রাচীর আসুক, সব বাধার প্রাচীর ভেঙে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হয় তাহলে আমরা জাতি হিসেবে আগামী দিন এগোতে পারবো না। আমি একটা বিচারের মানদণ্ড তুলে ধরতে চাই। ১৯৫১ সালে মাত্র এক মাসের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করেছিলেন আমেরিকান আদালত। সেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন জুলিয়াস রোজেনবার্গ ও ইথেল রোজেনবার্গ। এ দম্পতির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা দেশের বিরুদ্ধে অপরাধ করছেন গুপ্তচরবৃত্তি করে। এ কারণে কোরিয়াদ্বীপে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ মারা গেছে। ওই দম্পতির বিচার প্রক্রিয়ায় আমেরিকার সিভিল সোসাইটি থেকে শুরু করে গোটা বিশ্ব জেগে উঠেছিল। সব নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীরা এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। খালাস দিতে বলেছিলেন। এই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার অবস্থায় গিয়েছিল। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তাদেরও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। দুজন মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর অবশ্যই একটি বড় ঘটনা। আমরাও মনে করি, নিশ্চয়ই এ আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করা, মৃত্যুদণ্ড হওয়া, কার্যকর হওয়া।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ন্যায় শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এই আসামিদের হাতে বাংলাদেশের অসংখ্য-অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। তাদের হাতে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবে। পাঁচ বছরের শিশু মারা যাবে। ১০ বছরের আনাস মারা যাবে। পানি বিতরণ করা অবস্থায় মুগ্ধ মারা যাবে। বুক চিতিয়ে আবার রাজপথে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদরা মারা যাবেন। আমরা যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি বা এই দুজনের বিচার ব্যাহত হয় অথবা শাস্তি না হয় যেটা আইনে প্রেসক্রাইব করা আছে– তাহলে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসে একটি ভীরু-কাপুরুষের উপমা হয়ে রয়ে যাবে। সেই কারণেই আমরা মনে করি, এই বিচারে আমরা যা প্রমাণ করেছি সেটা বিয়ন্ড অল রিজনেবল ডাউট (এ নিয়ে কোনও যুক্তিসংগত সন্দেহ নেই)।
আসামিদের প্রতি আকাঙ্ক্ষা রেখে আসাদুজ্জামান বলেন, আমি প্রত্যাশা করি ন্যায়বিচারের মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হলে এই আসামিরা বলবেন; যেমন বলেছিলেন জুলিয়াস নিজের আইনজীবীর মাধ্যমে। তিনি (জুলিয়াস) গোটা বিশ্বকে জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতা ও অন্য যেসব জিনিস জীবনকে সত্যিই সুন্দর-স্বার্থক করে তোলে তা পাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে খুব বেশি মূল্য দিতে হয়। তারা হয়তো এমন একটি উক্তি দিয়েই এই বিচারের রায় মেনে নেবেন। অন্য কোনও পথ বেছে নেবেন না। অন্য কোনও পথে তারা হাঁটবেন না। যেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য ভূমি গড়ে তোলা যায়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোনও শাসক-শোষক বা ফ্যাসিস্টকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি প্রত্যাশা করেছিলাম, তিনি ন্যায়বিচারের সামনে আসবেন। ক্ষমতায় থাকতে তিনি আরেকজন রাজনৈতিক নেতাকে বলেছিলেন, সাহস থাকলে বাংলাদেশের মাটিতে এসে বিচারের মুখোমুখি হোক। আমার বিশ্বাস ছিল, এ কথাটা মন থেকে বলেছিলেন। এটা বিশ্বাস করে বলেছিলেন। কিন্তু দেখলাম, তিনি মন থেকে বলেননি। তার যদি সাহস থাকতো তাহলে বাংলাদেশের মাটিতে এসে এই বিচারের মুখোমুখি হতেন।
শেষে ট্রাইব্যুনালের কাছে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজা প্রার্থনা করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
এদিন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ১৩ নভেম্বর এ মামলার রায়ের দিন নির্ধারণ করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।