‘এ্যালা মুই কেমন করি বাঁচিম? এ কেমন অন্যায় মোর সাথে হইল। ছোট ছাওয়াগুলাক কায় খাওয়াইবে, পড়াইবে? মোর নির্দোষ স্বামীক কেন মারিল? বেটিটার বিয়ার কি হইবে? মুই কার কাছোত বিচার চাইম?’—বুক ছাপড়ে আহাজারি করতে করতে অশ্রুসিক্ত চোখে কথাগুলো বলছিলেন ভারতী দাস।
গতকাল শনিবার (৯ আগস্ট) দিবাগত রাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি ‘ভুল’ সন্দেহে তার গোছানো সংসারের সবকিছু যেন মাটিতে মিশে গেছে। চোর সন্দেহে তার স্বামী রুপলাল দাস ও ভাগ্নে জামাই প্রদীপ দাসকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেই শোকে দিশেহারা ভারতী দাস। অথচ আজ তার বাড়িতে মেয়ে নুপুরের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করার কথা ছিল।
কাঁদতে কাঁদতে বারবার মুর্ছা যাওয়া ভারতী দাসের চোখ লাল হয়ে গেছে। সন্তানদের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে গলা ভাঙা কণ্ঠে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন তিনি। তাদের চোখে মুখেও অবুঝ আতঙ্ক, কিন্তু বোঝার মতো বয়স হয়ে গেছে যে তাদের বাবা আর ফিরবেন না।
রোববার (১০ আগস্ট) দুপুরে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ঘনিরামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রুপলাল দাসের বাড়িতে চলছে আহাজারি, মাতম। দলে দলে আশপাশের গ্রামের লোকজন ও প্রতিবেশীরা বাড়ির ভেতরে-বাইরে ভিড় করছে।
রুপলাল দাস ঘনিরামপুর গ্রামে চার শতক জমির ওপর বাঁশের টিনের বেড়া ঘেরা দুটো টিনের চালা তুলে বসবাস করে আসছিলেন। সেই ছোট্ট টিনের ঘরটিতে সকাল থেকেই কান্নার শব্দ থামছে না। কারণ রুপলাল দাসই ছিল অসহায় এই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার উপার্জনে চলত বৃদ্ধ মা, স্ত্রী আর তিন সন্তানসহ ছয় সদস্যের সংসার।
শনিবার সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত রুপলালের ঘরে ছিল আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের প্রস্তুতি। ছিল বড় মেয়ে নুপুরের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা নিয়ে ব্যস্ততা। বাকি দুই ছোট ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও স্বপ্ন দেখতেন রুপলাল। কিন্তু শনিবার রাতের একটি ভুলই রুপলালের পরিবারের স্বপ্ন ভঙ্গ করে দিলো।
বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকা বড় মেয়ে নুপুর (১৮) যেন নির্বাক হয়ে গেছেন। তার চোখে জল, ঠোঁটে ক্ষোভ। গলায় বুকভাঙা আহাজারি। চারপাশ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলছিলেন— ‘অ্যালা কায় মাও কয়া ডাকপে? হামরা যে এতিম হয়া গেইনো। হামাক নিঃস্ব বানাইল।’
নুপুর বলেন, ‘আজ আমার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা। এ জন্য প্রদীপ দাদা আমাদের বাড়িতে আসতে ছিল। রাস্তা না চেনায় বাবা দাদাকে কাজীরহাট থেকে আনতে যায়। সেখান থেকে প্রদীপের ভ্যানে চড়ে বাড়ি ফেরার পথে বটতলায় লোকজন আটক করে মারধর করে। খবর পেয়ে রাতে বুড়িরহাট গিয়ে বাবা-দাদার রক্তাক্ত দেহ শনাক্ত করি।
পুলিশ, পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, নুপুরের বিয়ের দিনক্ষণ তারিখ ঠিক করার জন্য মিঠাপুকুর থেকে ভাগনি জামাই প্রদীপ দাস ভ্যানে করে তারাগঞ্জ আসেন। কিন্তু পথ অচেনা হওয়ায় তাকে আনতে বাড়ি থেকে রুপলাল রওনা হয়েছিলেন। সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলায় স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে ‘ভ্যান চোর’ সন্দেহে আটকা পড়ে যান তারা। বস্তায় পাওয়া কয়েক বোতল তরলের ঘ্রাণে দুজন অসুস্থ হয়ে পড়লে সন্দেহ আরও বাড়ে। আর তারপর শুরু হল নির্মম মারধর—যা শেষ পর্যন্ত কেড়েছে দুটি অসহায় প্রাণ।
গ্রামের প্রবীণ জয়নাল আবেদীন বলেন, রুপলাল দীর্ঘদিন তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই করতেন। সে কখনো কারও সঙ্গে খারাপ কথা বলেননি। এইভাবে মানুষ মারা—এটা অমানবিক। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে পুরো পরিবার।
কুর্শা ইউনিয়ন সদস্য (মেম্বার) তুহিনুর ইসলাম বললেন, ওর (রুপলাল) মেয়ের বিয়ের কথা ছিল। তাকে মেরে ফেলায় এই পরিবার এখন পুরো অসহায়। আল্লাহ্ জানেন তাদের সংসার কেমন চলবে।
তারাগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, নিহত রুপলালের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। নিহতের স্ত্রী ভারতী দাস বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন।
উল্লেখ্য, শনিবার রুপলালের মেয়ে নুপুরের বিয়ের দিন ঠিক করতে মিঠাপুকুর থেকে প্রদীপ দাস রুপলালের বাড়ির দিকে রওনা হন। পথে রাস্তা না চেনায় কাজীরহাট এলাকায় গিয়ে রুপলালকে ফোন করেন প্রদীপ দাস। তার ফোন পেয়ে রুপলাল কাজীরহাটে যান। সেখান থেকে রাতে ৯টার দিকে সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছলে ভ্যান চোর সন্দেহে তারা দুজন মারধরের শিকার হন।
প্রদীপের ভ্যানে থাকা চারটি বোতলের গন্ধে স্থানীয় কয়েকজন অসুস্থতা বোধ করলে চোর সন্দেহ আরও বাড়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা আবার মারধর শুরু করলে একপর্যায়ে রুপলাল ও প্রদীপ অচেতন হয়ে পড়েন। পরে পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। রাতেই রুপলালকে মৃত ঘোষণা করা হয়। আর আজ রোববার ভোরে মারা যান প্রদীপ।