বাঁধন ছেঁড়া ভালোবাসা, শিকড়ের টান আর সংস্কৃতির উজ্জ্বল আলো জ্বেলে ফ্রাঙ্কফুর্টের বিখ্যাত ওষ্ট পার্ক যেন রূপ নিয়েছিল এক খণ্ড বাংলাদেশে। গ্রীষ্মের ছোঁয়ায় উজ্জ্বল দুপুর ১১টা থেকে শুরু হয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত এক অবিস্মরণীয় দিনে, জার্মানির প্রবাসী বাঙালিরা মিলেছিলো এক ঐতিহাসিক মহামিলনে-যা শুধু উৎসব নয়, ছিলো এক আবেগমাখা সাংস্কৃতিক পুনর্মিলন।
অনুষ্ঠানের সূচনা হয় বেলুন উত্তোলনের মধ্য দিয়ে, আকাশে উড়াল দেয় রঙিন আশার বার্তা। জাতীয় সংগীতের গম্ভীর সুরে যখন তাপসী রায়ের কণ্ঠ ছুঁয়ে যায় প্রান্তর, তখন মনে হয়-মাটি আর মানুষের বন্ধন কোনো সীমান্ত মানে না।
জার্মানির নিবন্ধিত বিশটি সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই মহামিলনে যোগ দেন, আর তাঁদের উপস্থিতিতে প্রবাসে বসে গড়ে ওঠে এক অনন্য ঐক্যের বার্তা। মেলার মাঠে সাজানো হয় আটটি উদ্যোক্তা স্টল—রঙ-বেরঙের শাড়ি, হ্যান্ডিক্রাফ্ট, গহনা, মেহেদি আর বাঙালি মেয়েলিপনার অনবদ্য ঝলক যেন বাংলার হাট-বাজারকেও হার মানায়। মুগ্ধ চোখে মানুষ ঘুরে বেড়িয়েছে, ছুঁয়ে দেখেছে আপন রঙের সুখ।
পার্কজুড়ে ছিলো লাচ্ছি, চা, ঝালমুড়ি, পানের ঘ্রাণ এক নিঃশ্বাসে যেন ফিরে যাওয়া মায়ের রান্নাঘরে, গ্রামবাংলার প্রিয় বিকেলে।
সুর আর সঙ্গীতে সেজে উঠেছিলো অনুষ্ঠান। দেশের গন্ধমাখা গানের সাথে বাজতে থাকে যন্ত্রসংগীত, যার ঢেউ এসে লাগে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শিল্পীদের হাতে। তাপসী রায়, জালাল আবেদিন, রঞ্জু সরকার, লুৎফর, সেজুতি, রিয়েল আনোয়ার, এনামুল হক, মিতি, রতন ইসলাম ,নিম্মি কাদের , মুক্তা খান আখির কণ্ঠে প্রবাসীরা খুঁজে পায় তাদের শিকড়ের সুর।
খেলাধুলাতেও কমতি ছিলো না। ফ্রাঙ্কফুর্ট, ওফেনবাখ, ক্লোন, মানহাইমসহ বিভিন্ন শহর থেকে আসা ফুটবলপ্রেমীরা মাঠে নামেন। প্রতিযোগিতার উত্তেজনা আর ক্রীড়ার আনন্দ মিলেমিশে এক হয়ে যায়। শেষে চ্যাম্পিয়ন ও রানারআপ দলকে দেওয়া হয় পুরস্কার, গর্বিত মুখগুলোতে ঝিলমিল করে বিজয়ের হাসি।
সবশেষে, কাইয়ুম চৌধুরী ও ফাতেমা রহমান রুমার প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে ছন্দে বাঁধা এক কাব্য। আরও সৌন্দর্য যোগ করে লন্ডন থেকে আগত মিডিয়া পার্টনার এ আর টেলিভিশন ও স্থানীয় জার্মান বাংলা চ্যানেল যারা এই মিলনমেলার সাক্ষী রেখে দেয় প্রজন্মের পর প্রজন্মে।
এ যেন শুধু একটি অনুষ্ঠান নয় - এ এক আত্মার মিলন, শিকড়ের আর্তি, আর প্রবাসে থেকেও প্রিয় মাতৃভূমিকে বুকে ধারণ করার এক অনবদ্য প্রয়াস। ফ্রাঙ্কফুর্টের সেই সন্ধ্যা তাই শুধুই আলোয় ভরা ছিলো না, ছিলো ভালোবাসায় গড়া এক চিরস্মরণীয় দিন।