অর্ধেক পথ পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেলেমে চলমান বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-৩০। এর শুরু হয়েছিল স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার নতুন আলোয়। কিন্তু অর্ধেক পথ পেরোতেই দেখা দিচ্ছে কঠিন বাস্তবতা; নেই প্রত্যাশিত অগ্রগতি, নেই বহুল প্রতিশ্রুতি সমন্বিত উচ্চাভিলাষ।উন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করে ঠিকই। কিন্তু তাদের কণ্ঠে দৃঢ়তার চেয়ে কূটনৈতিক জটিলতার রেশই বেশি। অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো তাকিয়ে আছে এ সম্মেলনকে তাদের শেষ আশ্রয়, শেষ সুযোগ ভেবে।
বেলেমের কনভেনশন সেন্টারের বাইরে হাজারো মানুষের স্লোগানে যেন অন্য এক সত্য ফুটে উঠছে-আমরা সময় হারাচ্ছি। শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের প্রভাব ও স্বার্থের অঙ্কে ব্যস্ত। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে- সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিন-দিন যেভাবে বাড়ছে, কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ঠিক সেভাবেই পিছিয়ে যাচ্ছে। অভিযোজন তহবিল বৃদ্ধি, সহজ শর্তের ঋণ, প্রযুক্তির ন্যায্য প্রাপ্তি-আলোচনায় এসব দাবি আজও উপেক্ষিত।
অর্ধেক পথ পেরিয়ে কপ-৩০ যেন এমন এক সম্মেলনে পরিণত হয়েছে, যার ভেতরে সময়ের চাকা ঘুরছে খুব ধীরে। আলোচনার জট, বিভাজন, রাজনৈতিক টানাপড়েনÑসব মিলিয়ে ‘অগ্রগতির সম্ভাবনা’ দিনে দিনে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে সম্মেলনস্থলের মূল প্রবেশদ্বারে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করে আমাজন অঞ্চলের আদিবাসী মুণ্ডুরুকু সম্প্রদায় কপ-৩০ সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগোর সঙ্গে জরুরি বৈঠকের দাবি তোলে। আমাজনের প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাসরত এ জনগোষ্ঠীর দাবি, ‘আমরাই জলবায়ুর প্রকৃত রক্ষক; আমাজনকে আর ধ্বংসের পথে এগোতে দেওয়া যাবে না।’ পরে কপ-৩০ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে আদিবাসী প্রতিনিধিরা প্রশ্ন তোলেন, যদি আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ না করা হয়, তবে তাঁদের কেন বেলেমে আনা হলো? কপ-৩০ সভাপতি দো লাগো প্রতিশ্রুতি দেন, তাঁদের জন্য বাড়তি কনফারেন্স পাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তেল-গ্যাসসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে ‘ধীরে ধীরে সরে আসার’ প্রতিশ্রুতি কপ-২৮ এ দেওয়া হলেও তা এবার আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচিতে না থাকায় অনেকেই শঙ্কিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত দেশগুলো শত শত সদস্য নিয়ে আলোচনায় অংশ নিলেও অনেক স্বল্পোন্নত দেশ দুই-তিনজন প্রতিনিধিকে নিয়ে বৈশ্বিক আলোচনার ‘জটিল দাবার গুটি’ সামলাতে হিমশিম খায়। ফলে সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয় শক্তিধর দেশগুলোর পক্ষে।
সমালোচকরা বলেছেন, ফলপ্রসূ সমাধানের চেয়ে লবিস্টদের উপস্থিতি ও জটিল আমলাতান্ত্রিক কাঠামো জলবায়ু সম্মেলনকে কার্যত বার্ষিক ‘বাণিজ্য মেলায়’ পরিণত করছে। সম্মেলনে যে পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির লবিস্ট অংশ নিচ্ছেন, তা বহু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সম্মিলিত প্রতিনিধির চাইতেও বেশি।
কপ-৩১ আয়োজন নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও তুরস্কের বিরোধও জমে উঠেছে। দুটি দেশই ২০২২ সালে আবেদন করেছিল এবং এখনো কেউ সরে দাঁড়াতে সম্মত নয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র তিন দশকের ইতিহাসে এবারই প্রথম উচ্চপর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধিদল পাঠায়নি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ায় কপ-৩০এ দেশটির অনুপস্থিতি স্পষ্ট। এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে এসেছে চীন। দেশটির প্রতিনিধিরা বলেছেন, তাঁদের নবায়নযোগ্য শক্তির নেতৃত দক্ষিণের দেশগুলোকে শক্তিশালী করছে। চীনা কূটনীতিকরা এবার পর্দার আড়ালেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। আলোচনার শুরুতেই এজেন্ডা চূড়ান্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় বেইজিং, যা আগের কপগুলোতে দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃহত্তর নেতৃত্ব দেখাতে হলে চীনকে আরও উচ্চাভিলাষী নির্গমন কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
কপ-৩০ এর শেষ সপ্তাহে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার জন্য নতুন মন্ত্রীপর্যায়ের জুটি ঘোষণা করা হয়েছে। জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন, প্রশমন, প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা এগিয়ে নিতে এসব জুটি আলোচনায় নেতৃত্ব দেবেন। প্রেসিডেন্সি সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাজ্য ও কেনিয়া একসঙ্গে কাজ করবে জলবায়ু অর্থায়ন ইস্যুতে। গাম্বিয়া ও জার্মানি দায়িত্ব পেয়েছে অভিযোজন আলোচনার। মিশর ও স্পেন নেতৃত্ব দেবে প্রশমন বিষয়ে। এ ছাড়া বৈশ্বিক পর্যালোচনার দায়িত্ব পেয়েছে নরওয়ে ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর নিয়ে কাজ করবে মেক্সিকো ও পোল্যান্ড। আর প্রযুক্তি হস্তান্তর আলোচনায় নেতৃত্ব দেবে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত।
জলবায়ু আলোচনায় বিভিন্ন ইস্যুতে এখনও বিভাজন রয়ে গেছে। তবে ইতিবাচক দিক হলো, ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে একটি রোডম্যাপ তৈরির পক্ষে সমর্থন দিন-দিন বাড়ছে। এদিকে স্বাগতিক ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা আলোচনার শুরুতেই এক অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি ‘কল অব বেলেম ফর দ্য ক্লাইমেট’ নামে একটি রাজনৈতিক আহ্বানপত্র প্রকাশ করেন। এতে তিনি দেশগুলোকে আহ্বান জানানÑ অভিযোজন তহবিল উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে হবে, প্রয়োজনে বর্তমান তহবিল তিনগুণ পর্যন্ত বাড়াতে হবে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্বলতা কমানো এবং জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলার জরুরি প্রয়োজন বিবেচনায় অনুদানভিত্তিক এবং সহজ শর্তের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
কপ-৩০ এখন প্রবেশ করেছে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে। জটিল অবস্থান, রাজনৈতিক টানাপড়েন এবং ধীর আলোচনার ছন্দ সত্ত্বেও বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা- শেষ সপ্তাহে ফের আলো জ্বলে উঠবে। দেশগুলো উচ্চাভিলাষ বাড়াবে, মানুষের বাঁচার দাবিকে প্রাধান্য দেবে এবং পৃথিবীকে রক্ষার পথ দেখাবে।
বেলেমে চলমান কপ৩০-এর ষষ্ঠ দিনে গতকাল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল জলবায়ু রূপান্তরের জন্য বৈশ্বিক অর্থায়ন জোরদার করা। এ দিন উচ্চপর্যায়ের সভা, ঘোষণাপত্র ও আলোচনায় উঠে এসেছে ন্যায়সংগত রূপান্তর নিশ্চিত করতে আর্থিক কাঠামো শক্তিশালী করার বিষয়টি।