
রুশ ড্রোন অনুপ্রবেশে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ন্যাটো। রাশিয়ার ড্রোন হামলা প্রতিহত করাই এখন আকাশ প্রতিরক্ষায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১১০ সেপ্টেম্বর ন্যাটো প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে বড় আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ওইদিন ১৯টি রুশ ড্রোন পোল্যান্ডের আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ করে। তবে বেশ কিছু ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করা হয়।
ইতালির ট্যাংকার এবং জার্মানির প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও রুশ ড্রোন প্রতিহত করতে পোল্যান্ডের সঙ্গে অংশ নেয়। তবে পোল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের যুদ্ধবিমান কেবল অল্প কয়েকটি ড্রোন ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটে এটাকে ‘খুব সফল প্রতিক্রিয়া’ বলে অভিহিত করেছেন।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর রোমানিয়াও তাদের আকাশে রুশ ড্রোন প্রবেশের খবর নিশ্চিত করে। একই দিনে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে অনাগ্রহ দেখিয়ে বলেন, ‘এটা আমাদের যুদ্ধ নয়।’ এখন প্রশ্ন উঠেছে-ন্যাটো কি সত্যিই ইউরোপের আকাশকে রাশিয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে?
যদিও ন্যাটোর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কয়েকটি স্তরে গঠিত। প্রথম ধাপ হলো- হুমকি শনাক্ত করা। ন্যাটোর যৌথ মালিকানায় থাকা ১৪টি এয়ারবোর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল (এইউডব্লিউসি) বিমান সাধারণত জার্মানির গেইলেনকির্শেনে অবস্থান করে। এগুলো পূর্ব দিকের অনেক ভেতর পর্যন্ত নজরদারি চালিয়ে রুশ যুদ্ধবিমান, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র পর্যবেক্ষণ করে। এগুলোর সঙ্গে রয়েছে আরকিউ-৪ডি ফিনিক্স ড্রোন, যা সিসিলির সিগোনেল্লা ঘাঁটি থেকে দীর্ঘ সময় ধরে উঁচু আকাশে উড়ে নজরদারি চালায়। এছাড়া পোল্যান্ড প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাডারযুক্ত এ্যারোস্ট্যাট (বেলুন) কিনছে, যা আকাশে বন্ধু এবং শত্রু বিমান চিহ্নিত করতে পারে। মার্কিন বাহিনীও ইউক্রেনের মতো শব্দ-সেন্সর ব্যবহার করে ড্রোন শনাক্তের পরীক্ষা চালিয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে যুদ্ধবিমান মোতায়েন। মিত্রদেশগুলো পালাক্রমে পূর্ব ইউরোপে বিমান মোতায়েন করে। বর্তমানে ইতালি, স্পেন ও হাঙ্গেরি বাল্টিক আকাশসীমা পাহারা দিচ্ছে, ইতালি রোমানিয়াতেও টহল দিচ্ছে এবং নেদারল্যান্ডস ও নরওয়ে পোল্যান্ডের আকাশসীমা পাহারা দিচ্ছে। প্রয়োজন হলে এসব বিমান রুশ বিমানের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও ধ্বংস করতে পারে। গত ১১ সেপ্টেম্বর ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তিনটি রাফায়েল যুদ্ধবিমান পোল্যান্ডে পাঠানোর ঘোষণা দেন।
তৃতীয় ধাপ হলো স্থলভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর নিজস্ব রাডার ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকলেও জার্মানি পোল্যান্ডে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যাটারি পাঠিয়েছে। নেদারল্যান্ডসও পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু মিত্র দেশ সমুদ্র থেকে রাডার ও প্রতিরোধক ক্ষেপণাস্ত্রসহ ডেস্ট্রয়ার জাহাজ চালায়। এছাড়া রোমানিয়া ও পোল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের স্থলভিত্তিক রাডার রয়েছে।
এসব কিছুই ‘ইন্টিগ্রেটেড এয়ার অ্যান্ড মিসাইল ডিফেন্স’ (আইএএমডি)-এর সমন্বিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ, যা পরিচালিত হয় জার্মানির রামস্টেইনে অবস্থিত ন্যাটোর এলাইড এয়ার কমান্ডের অধীনে। এর নিচে রয়েছে দুইটি কম্বাইন্ড এয়ার অপারেশন সেন্টার- একটি জার্মানিতে, যা আল্পসের উত্তরের আকাশসীমা তত্ত্বাবধান করে, অন্যটি স্পেনে, যা দক্ষিণাঞ্চল তত্ত্বাবধান করে।
তাত্ত্বিকভাবে এটি এক বিশাল প্রতিরক্ষা ঢাল। কিন্তু বাস্তবে কিছু বড় দুর্বলতা রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাপক বোমাবর্ষণের কারণে ইউরোপ থেকে অনেক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এরমধ্যে ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছে। আগস্টে জার্মানি চাপের মুখে দুটি অতিরিক্ত প্যাট্রিয়ট সিস্টেম ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। গত জুন মাসে মার্ক রুটে বলেছিলেন যে, জোটকে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ পরিকল্পনা পূরণের জন্য তাদের বিমান-প্রতিরক্ষা সম্পদ ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো ছোট আকারের ড্রোন শনাক্ত করা কঠিন। রুশ ড্রোন আগে বহুবার ন্যাটোর আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে রোমানিয়ায় রুশ ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ পড়েছে, ২০২৪ সালের মার্চে ক্ষেপণাস্ত্র পোল্যান্ড অতিক্রম করেছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে লাটভিয়ায় একটি ড্রোন বিধ্বস্ত হয় এবং চলতি সেপ্টেম্বর মাসেই দুইবার ড্রোন পোল্যান্ডে প্রবেশ করেছে। একবার ইউক্রেনীয় সীমান্ত থেকে ৪০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে বাইডগোসজকের কাছে বিধ্বস্ত একটি রাশিয়ান ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র উদ্ধার করতে পোল্যান্ডের কয়েক মাস সময় লেগেছিল। তবে ১০ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় পোল্যান্ড বেশিরভাগ ড্রোন উপেক্ষা করেছে, কারণ সেগুলোকে নিরস্ত্র বলে মনে করা হয়।
এছাড়া বড় আকারের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে ছোট ও সস্তা ড্রোন নামানো অর্থনৈতিকভাবে ব্যয়সাপেক্ষ। লন্ডনের আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইআইএসএস) বলছে, গেরবেরা ড্রোনগুলো খুবই সস্তা, স্টাইরোফোম দিয়ে তৈরি এবং মূলত ডিকয় হিসেবে নকশা করা। ন্যাটো দেশগুলো লেজার, কামান ও রকেটভিত্তিক স্বল্প-পাল্লার ড্রোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করছে, কিন্তু তা এখনো ব্যাপক আকারে কার্যকর হয়নি।
রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাবও একটি বড় সমস্যা। ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ঢাল অনেকাংশে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছে। ইউরোপীয় যুদ্ধবিমান শত শত থাকলেও সেগুলোর কমান্ড ও কন্ট্রোল এখনো মার্কিন নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। ১১ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প রাশিয়ার আক্রমণকে হালকাভাবে নিয়ে বলেন, এটা হয়তো ভুলবশত ঘটেছে।
এখন প্রশ্ন উঠছে যে, ইউরোপ কী এই শূন্যস্থান পূরণ করতে প্রস্তুত? ইউক্রেন অভিযোগ করেছে, ন্যাটো অনেক সময় রুশ হামলা গোপন রাখে যেন পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত না হয়। তবে পোল্যান্ড এবার রুশ ড্রোন ধ্বংস করে প্রকাশ্যে বলেছে যে, এটি ইচ্ছাকৃতভাবে পোল্যান্ডকে লক্ষ্য করে পাঠানো হয়েছিল।
কিন্তু এখনো ইউরোপ ইসরায়েলের মতো আক্রমণের আগে শত্রু ড্রোন গুলি করে নামাতে রাজি নয়। কারণ ন্যাটোর বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, যৌথভাবে বেলারুশ বা ইউক্রেনের আকাশে কিছু গুলি করে নামাতে হলে ৩২টি সদস্য দেশের সর্বসম্মত অনুমোদন লাগবে-যা হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া প্রায় নিশ্চিতভাবেই আটকে দেবে। বড় যুদ্ধ শুরু হলে এসব নিয়ম হয়তো পাল্টে যাবে, কিন্তু আপাতত বলা যায় যে, ইউরোপ প্রতিরক্ষায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে।