সংগীত ভূবনের বহুমাত্রিক, বিষ্ময়কর ও অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী সংগীত স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গ্রামোফোন রেকর্ডের গান নিয়ে প্রায় ৪ হাজারের মত গান সৃষ্ট করেছেন। নজরুলের গানগুলি তাঁর সমস্ত হৃদয়ের গভীরতম শিল্পসুষমায় ফুটে উঠেছে। সংগীতের ক্ষেত্রে নজরুলের সৃষ্টি ক্ষমতা পৃথিবীর যে কোন সংগীত স্রষ্টার চেয়ে অনেক বেশী উজ্বল। নজরুল একমাত্র সংগীত স্রষ্টা যিনি বিভিন্ন বিদেশী শব্দ এবং সুর সমন্বয় করে আমাদের বাংলা গানকে করেছেন সম্মৃদ্ধ।
নজরুলের সংগীত রচনাকালকে চারটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথমতঃ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চের পর থেকে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর পর্যন্ত যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধকরণ ও শোষনমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার স্বরূপ উদ্দীপনাময় দেশাত্ববোধক গান রচনাকাল; দ্বিতীয়তঃ ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের পর থেকে ১৯২৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত পারস্য গজলের অনুপ্রেরণায় বাংলা গজল রচনাকাল; তৃতীয়তঃ ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত গ্রামোফোন কোম্পানী, মঞ্চ ও চলচ্চিত্র-কেন্দ্রিক বিভিন্ন আঙ্গিকের গান রচনাকাল এবং চতুর্থত ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বেতার-কেন্দ্রিক গান ও রাগ-সঙ্গীত নিয়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষামূলক বিবিধ গান রচনাকাল হিসাবে উল্লেখযোগ্য।
সংগীতের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য কোন বিশেষনই কাজী নজরুল ইসলামের জন্য যথেষ্ট নয়। কাজী নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র সাম্যবাদী গণসংগীতের স্রষ্টাই নন। তিনি বাংলা গজল গানের প্রবর্তক। এই দুই ধারার সংগীতে সুরের যে বৈচিত্র তা বিষ্ম্য়কর। বিশেষ করে ১৯২৬-১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে যে ’গজল’ গানগুলো সৃষ্টি করেন তা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত আধুনিক এবং বর্তমান সুরস্রষ্টাদের কাছে অনুুকরণীয়। বর্তমান সময়ের সুর স্রষ্টারা তার গজল গানকে অনুসরন করে নূতন নূতন গান সৃষ্টি করে চলেছেন। নজরুল তাঁর গজলের সুরে প্রচলিত অনুসাশন থেকে বেড় হয়ে গজলের মধ্যে শেয়র-এর অনুপ্রবেশ ঘটান। ’শেয়র’ হল গানের মধ্যে হঠাৎ কয়েকটি পংক্তির আবৃত্তি এবং আবৃত্তির পর পুণরায় গানের মূল তাল ও লয়ে ফিরে আসা।
আমরা যতই তাঁর সৃষ্টির গভীরে প্রবেশ করি ততই অবাক হই। তাঁর উজ্জ্বলতম উপস্থিতি গজল গানকে নিয়ে আলোকপাত করি-
ক. পারস্য গজলের বিষয়ানসঙ্গে রচিত বা অনুবাদকৃত গজল
১. আজ বাদে কাল আসবে কিনা কে জানে কে জানে, ২. আজ সুদিনের আস্লো উষা, নাই অভাব আজ নাই অভাব, ৩. আনো সাকী শিরাজী আনো আঁখি-পিয়ালা, ৪. আমরা পানের নেশার পাগল, লাল শারাবে ভর গেলাস, ৫. আরো নূতন নূতনতর শোনাও গীতি গানেওয়ালা, ৬. আল্গা করগো খোঁপার বাঁধন দীল ওঁহি মেরা ফাঁসগায়ি, ৭. আসলো যখন ফুলের ফাগুন, গুলবাগে ফুল চায় বিদায়, ৮. এত ফূলের মরশুম শাবাব ঢালো সাকী, ৯. ঐ লুকায় রবি লাজে মুখ হেরি’ মম প্রিয়ার, ১০. করুণ কেন অরুণ-আঁখি দাও গো সাকী দাও শারাব, ১১. কানন-গিরি সিন্ধু -পার ফিরনু পথিক দেশ-বিদেশ, ১২. মদির আঁখির সুধায় সাকী, ডুবাও আমার এ তনু মন, ১৩. গুল-বাগিচার বুলবুলি আমি রঙীন প্রেমের গাই গজল, ১৪. চাঁদের পিয়ালাতে আজি জোছনা-শিরাজী ঝরে, ১৫. যেদিন লব বিদায় ধরা ছাড়ি’ প্রিয়ে, ১৬. শূন্য আজি গুল-বাগিচা যায় কেঁদে দখিন হাওয়া
১৭. গোলাব ফুলের কাঁটা আছে সে গোলাব শাখায়, ১৮. পিও শারাব পিও, তোরে দীর্ঘ সে-কাল গোরে হবে ঘুমাতে, ১৯. কোন মাটিতে আমার কায়া সৃজিলে হায় প্রভু মোর, ২০. সৃজন-ভোরে প্রভু মোরে সৃজিলে গো প্রথম যবে, ২১. ভোরের হাওয়া ধীরে ধীরে ব’লো গো সেই হরিণীরে, ২২. দোষ দিওনা প্রবীন জ্ঞানী হেরি’ খারাব-খোর, ২৩. চাঁদের মতন রূপ গেল রূপ তোমার রৌশন রূপ-বিভায়, ২৪. তরুণ প্রেমিক প্রণয়-বেদন জানাও জানাও বে-দিল প্রিয়ায়, ২৫. রে অবোধ! শূন্য ধুলো মাটির ধরা, ২৬. জাগো সাকী হাম-দরদী জাম-বাটিতে দাও শরাব, ২৭. বুক-ব্যথানো বেণুর বেদন বাজিয়েছিল কাল রাতে, ২৮. হে মোর সুন্দর! চাঁদের চাঁদ-মুখ তোমার রৌশন; রূপমেখেই, ২৯. মোর পাত্র মদ্য রোশনায়ে কর রৌশন এয় সাকি, ৩০. কোথায় সুবোধ সংযমী, তা’রতুল এ-মাতাল অপাত্রে ছাই! ৩১. যদিই কাস্তা সিরাজ সজনী ফেরত দেয় মোর চোরাই দিলফের
৩২. হাত হতে মোর হৃদয় যায় দোহাই বাঁজাও হৃদয়-বাণ।
খ. পারস্য গজলের বিষয়ানুষঙ্গের মৃদু স্পর্শে রচিত গজল
১. আনো গোলাপ পানি, আনো আতরদানি গুলবাগে, ২. আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদী
৩. আসিলে এ ভাঙ্গা ঘরে কে মোর রাঙা-অতিথি, ৪. একি সুরে তুমি গান শোনালে, ৫. এ কুঞ্জে পথ ভুলি’ কোন বুলবুলি আজ গাইতে এলে, ৬. কে বিদেশী বন-উদাসী, ৭. রংমহলের রংমশাল মোরা আমরা রূপের দীপালি, ৮. দূর বনান্তের পথ ভুলি’ কোন্ বুলবুলি, ৯. নতুন নেশার আমার এ মদ, ১০. নিশি ভোর হ’ল জাগিয়া পরান পিয়া, ১১. বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল, ১২. বিরহের গুলবাগে মোর ভুল ক’রে আজ ফুটলো কি বকুল, ১৩. (যবে) আঁখিতে ওরা কহে কথা দু’টিতে বনের পাখী, ১৪. সাকী বুলবুলি কেন কাঁদে গুল-বাগিচায়।
গ. সম্পূর্ণ বাংলা কাব্যধারানুষঙ্গে রচিত গজল
১. আগুন জ্বালাতে আসিনি গো আমি, ২. আজি অলি ব্যাকুল ওই বকুলের ফুলে, ৩. আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে, ৪. আধো আধো বোল লাজে বাধো বাধো বোল, ৫. আমার যাবার সময় হ’ল দাও বিদায়
৬. আমি যেদিন রইব না গো, ৭. আসে বসন্ত ফুলবনে সাজে বনভূমি সুন্দরী, ৮. উচাটন মন ঘরে রয় না
৯. এ আঁখিজল মোছ পিয়, ভোলো ভোলো আমারে, ১০. এ কোথায় আসিলে হায় তৃষিত ভিখারী, ১১. একলা ভাসাই গানের কমল সুরের স্রোতে, ১২. এত কথা কি গো কহিতে জানে, ১৩. এ নহে বিলাস বন্ধু ফুটেছি জলে কমল, ১৪. এত জল ও-কাজল-চোখে পাষাণী, আনলে বল কে, ১৫. ঐ ঘর ভুলানো সুরে কে গান গেয়ে যায় দূরে, ১৬. ওই জলকে চলে লো কার ঝিয়ারী, ১৭. এত কথা ছিল বলিবার, বলা হ’ল না, ১৮. কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে আসলে প্রাতে পুস্প-চোর, ১৯. কাহার তরে হায় নিশিদিন কাঁদে মন প্রাণ, ২০. কে মোর ব্যাথার গানে, ২১. কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি, ২২. কেন আন ফুল ডোর, ২৩. কেন আসিলে ভাল বাসিলে দিলে না ধরা জীবনে যদি, ২৪. কেন কাঁদে পারান কী বেদনায়, ২৫. কেন দিলে এ কাঁটা যদি গো কুসুম দিলে, ২৬. কেন ফোটে কেন কুসুম ঝরে যায়, ২৭. কেমনে রাখি আঁখি-বারি চাপিয়া, ২৮. গহীন রাতে ঘুম কে এলে ভাঙাতে, ২৯. চেয়োনা সুনয়না আর চেয়োনা, ৩০. চোখের নেশার ভালাসাসা সে কি কভু থাকে গো, ৩১. ছাড় ছাড় আঁচল বঁধু, ৩২. জাগো জাগো রে মুসাফির, ৩৩. ডেকে ডেকে কেন তারে ভাঙালি ঘুমের ঘোর, ৩৪. তোমার কুসুম বনে আমি আসিয়াছি ভুলে, ৩৫. তোমার বুকের ফুলদানিতে ফুল হব বঁধু আমি, ৩৬. থাক সুন্দর ভুল আমার, ৩৭. দাঁড়ালে দুয়ারে মোর কে তুমি ভিখারিণী, ৩৮. দিতে এলে ফুল হে প্রিয় কে আজি, ৩৯. নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখিজল, ৪০. নাহি কেহ আমার ব্যথার সাথী, ৪১. নিরালা কানন পথে কে তুমি, ৪২. পথ চলিতে যদি চকিতে, ৪৩. পরদেশী বঁধূয়া এলে এতদিনে, ৪৪. পলাশ ফুলের মউ পিয়ে ঐ, ৪৫. পাষাণের ভাঙালে ঘুম কে তুমি, ৪৬. পিয়া পাপিয়া পিয়া বোলে, ৪৭. প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই, ৪৮. পানসে জোছনাতে কে চল গো, ৪৯. প্রিয় তব গলে দোলে যে হার, ৫০. ফাগুন রাতের ফুলের নেশায়, ৫১. ফিরে ফিরে দ্বারে আসে যায় কে নিতি, ৫২. বকুল চাঁপার বনে কে মোর, ৫৩. বনে মোর ফুল ঝরার বেলা, ৫৪. বসিয়া নদী কুলে, এলোচুলে কে উদাসিনী, ৫৫. বসিয়া বিজনে কেন একা মনে, ৫৬. বেসুর বীণায় ব্যথার সুরে, ৫৭. ভুলি কেমনে আজো যে মনে, ৫৮. মোর ঘুম ঘোরে এলে মানোহর, ৫৯. মুসাফির! মোছরে আঁখিজল, ৬০. যাবার বেলায় ফেলে যেও, ৬১. যে ব্যথায় এ অন্তর-তল, ৬২. রুমুঝুমু রুমুঝুমু কে এলে নুপুর পায়, ৬৩. সখি লো তায় আন ডেকে, ৬৪. হায় আঙিনায়! সখি আজো কি সেই চাঁপা ফোটে, ৬৫. হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে, ৬৬. হেনে গেল তীর তিরছ তার চাহনি।
ঘ. ইসলামী ঐতিহ্যনুষঙ্গে রচিত গজল
১. আমার হৃদয় শামাদানে জ্বালি, ২. ওগো মুর্শীদ পীর বলো, ৩. এ কোন মধুর শরাব দিলে, ৪. খোদার প্রেমে শরাব পিয়ে, ৫. ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়, ৬. মরুর ধুলি উঠলো রেঙে রঙীন গোলাপ-রাগে
৭. ভোর হল ওঠ্ জাগ মুসাফির, ৮. মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, ৯. যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার, ১০. সাহারাতে ফুটলো রে রঙীন গুলে লালা, ১১. হে মদিনার বুলবুলি গো গাইলে তুমি কোন গজল, ১২. ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, ১৩. আল্লাহ আমার প্রভু আমার নাহি ভয়
১৪. ইসলামের ঐ সওদা ল’য়ে এলো নবীন সওদাগর।
সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ
১। নজরুল জীবনী- ড. রফিকুল ইসলাম। ২। নজরুল সঙ্গীত কোষ- ব্রহ্মমোহন ঠাকুর। ৩। নজরুল সঙ্গীতের সুর- ইদ্রিস আলী। ৪। নজরুল সংগীত অভিধান- আবদুস সাত্তার।
লেখক: শেলু বড়ুয়া, সংগীত শিল্পী, সংগীত পরিচালক ও শিক্ষক