শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪ ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
 
শিরোনাম: ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ভবন ও দুযোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর পরিদর্শন করলেন প্রধানমন্ত্রী       মোবাইল ইন্টারনেট চালু হতে পারে আগামীকাল       মেট্রোরেল কবে চালু হবে বলা যাচ্ছে না: সেতুমন্ত্রী       আজ ঢাকাসহ ৪ জেলায় বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল       ঢাকা-বরিশাল রুটে সীমিত পরিসরে লঞ্চ চলাচল শুরু       অর্থনীতিকে পঙ্গু করতেই সহিংসতা চালানো হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী       আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী      


নতুন সরকারের অভিযাত্রা : সামনে আছে অনেক চ্যালেঞ্জ
আগে চারবার সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এগিয়ে রাখবেই
রাজু আলীম
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪, ৭:৩৬ PM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণের মাধ্যমে ফের শুরু হলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের অভিযাত্রা। এ নিয়ে টানা চতুর্থবারের এ যাত্রায় দেশের অভ্যন্তরে যেমন চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তেমনই রয়েছে দেশের বাইরেও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা, অর্থনৈতিক সংকট উতরানো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলার পাশাপাশি চলমান উন্নয়ন ধরে রাখাসহ দেশের অভ্যন্তরে রয়েছে আরও অনেক রকম চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে রপ্তানি আয়, বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সৃষ্ট টানাপড়েন তথা সম্পর্কের বরফ গলানোর মতো বিষয়গুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তৎপর হতে হবে। ঘরের-বাইরের এসব চ্যালেঞ্জের উত্তরণ ঘটাতে হবে নতুন এই মন্ত্রিসভার। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই গঠন করা হয়েছে নতুন মন্ত্রিসভা। নতুন মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের রদবদল এনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় এবারই প্রথম নতুন মুখ হিসেবে যুক্ত হলেন ১৪ জন। আগে বিভিন্ন মেয়াদে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, এমন পাঁচজন এবারের মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে এবং বিগত পনেরো বছর ধরে দেশ পরিচালনা করেছে, তার অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন মন্ত্রিসভা জনবান্ধব এবং দেশের কল্যাণে  গঠন করা  হবে - এটা সবার প্রত্যাশা ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা নবীন এবং প্রবীণদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে ইতিহাস গড়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। টানা চতুর্থবার এবং মোট পাঁচবার প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়ে তিনি এ অনন্য নজির স্থাপন করলেন। এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিশ্বে শেখ হাসিনা দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন নারী সরকারপ্রধান। এরই মধ্যে তিনি চার মেয়াদে ২০ বছর সরকারপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বকে ‘হার্ড পাওয়ার’ হিসাবে বর্ণনা করেছে টাইম ম্যাগাজিন, বিবিসির ভাষায় সেটা ‘ওয়ান উইমেন শো’। মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের করা বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় ৪৬তম স্থানে নাম আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ২০২২ সালে তার অবস্থান ছিল ৪২ নম্বরে। বিশ্বজুড়ে রাজনীতি, মানবসেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য, গণমাধ্যম, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি খাতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে আসা প্রভাবশালী নারীদের মধ্য থেকে ১০০ জনকে বেছে নিয়ে গত মাসে এই তালিকা প্রকাশ করে ফোর্বস। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন শেখ হাসিনা। নিজের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি চার মেয়াদে ২০ বছর সরকারপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।  শুরু হলো পঞ্চম ধাপের যাত্রা। এক সময় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অগ্রসারির এই সৈনিক বিরোধীদের সঙ্গে যুগপৎভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন।
বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পরিবারের সদস্যরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সে সময় ইউরোপে অবস্থানের কারণে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক শেখ হাসিনা রাজনীতিতে যুক্ত হন ছাত্রজীবনেই। ১৯৭৫ সালের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দিল্লিতে নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন ১৯৮১ সালে। ওই বছরই তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সামরিক শাসক এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ সালে প্রথম সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৮ম বারের মতো সংসদ-সদস্য নির্বাচত হয়েছেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে প্রথমবার বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও সর্বশেষ এ বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন শেখ হাসিনা। 
দেড় দশকে অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা। নির্বাচনের আগে দলীয় ইশতেহার ঘোষণার সময় এই স্বপ্ন দেখান তিনি। এবার এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে যাত্রা শুরু করলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয় শেখ হাসিনাকে। ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলায় রাজনীতি থেকে তাকে বাদ দেওয়ার সেই চেষ্টার মধ্যেই দৃঢ় মনোবল নিয়ে তিনি সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেন। তারপর থেকে বিভিন্ন প্রতিকূলতা কাটিয়ে অবিরাম গতিতে ছুটছেন শেখ হাসিনা। ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা লাগে অর্থনীতিতে। শক্ত হাতে বৈশ্বিক এই ধাক্কা কাটিয়ে যখন অর্থনীতিকে স্বস্তির জায়গায় আনেন, ঠিক সেই সময় শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেশের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনকে সংকটে ফেলে দেয়। রিজার্ভ কমতে থাকে, অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো শুরু করে সরকার পতনের একদফার আন্দোলন। নানা ইস্যু সামনে এনে যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের মিত্ররা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশে দাঁড়ায়। এ অবস্থার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যেখানে আবারও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে আওয়ামী লীগ। এবারের নির্বাচনি ইশতেহারেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দেশ থেকে অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরে ঘুস-দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয় রোধ, ঋণ-কর-বিলখেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং অবৈধ অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্তের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। হুঁশিয়ারির পাশাপাশি এবারের নির্বাচনে ইশতেহারেও আওয়ামী লীগ গুরুত্ব দিয়েছে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ওপর; ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ার কথা বলেছে দলটি। শেখ হাসিনা আরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করবেন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর দেশবাসীকে বিদেশি তথাকথিত প্রভুদের সম্পর্কে সতর্ক করেছেন তিনি। বলেছেন, তাদের (বিদেশি) কথা শুনে চললে বাংলাদেশ আর এগোবে না। 

আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী আমাদের রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব নয়। ঋণখেলাপির অবস্থা ভালো নয়। আর্থিক খাতের সব সূচকেই এখন একটি দৈন্যদশা বিরাজ করছে। এরকম অবস্থায় নতুন সরকারের একটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কর্মসূচি। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতি কমানো সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসছে। নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের এখনো নেতিবাচক মনোভাবের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মেরুকরণ হয়েছে। এখানে এক জোরদার কূটনীতি দরকার। বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী পক্ষ এ নির্বাচন নিয়ে জলঘোলা করতে চাইবে। তারা আন্তর্জাতিক মহলে লবিস্টও নিযুক্ত করেছে। এরকম পরিস্থিতিতে নতুন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা। এরই মধ্যে ভারত, রাশিয়া, চীন এই নির্বাচনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন নতুন সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। বিএনপি এখন পর্যন্ত এই নির্বাচন মেনে নেয়নি। তারা নির্বাচনের বিরুদ্ধে এবং নতুন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে সেটা বলাইবাহুল্য। এই আন্দোলনে তারা কতটুকু সফল হতে পারে সেটি পরের বিষয়। কিন্তু বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করার জন্য আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। সংগঠন এবং দলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নতুন সরকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং অস্বস্তি কাজ করছে। নতুন সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হবে যত দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্ভব দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, সেক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ প্রকাশ্য রূপ নিতে পারে। আর দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনাকে সরকারের অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশাল জয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। একইসঙ্গে টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তবে কাক্সিক্ষত মাত্রায় ভোট না পড়ায় নির্বাচন উৎসবমুখর হয়ে উঠতে পারেনি। দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির অংশ না নেওয়া নির্বাচনে ভোট কম পড়ার অন্যতম কারণ বলে ধারণা করা যায়। তাছাড়া আরও কিছু কারণে ভোটাররা ব্যাপকভাবে ভোটকেন্দ্রে আসেননি। সার্বিকভাবে নির্বাচনটিকে গ্রহণ করে নিয়েছেন বেশ কয়েকজন বিদেশি পর্যবেক্ষক। তারপরও সারা বিশ্বে এর কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা দেখার বিষয়। কারণ এর ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে দেশের রপ্তানি ও বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য। বস্তুত এ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা পেয়েছে বটে, তবে যেহেতু জনগণের একটি বড় অংশের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক শক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, সেহেতু দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ার একটি উপাদান রয়েই গেছে। সেক্ষেত্রে নতুন সরকারের উচিত হবে এটা কীভাবে দূর করা যায়, সেই চেষ্টা করা। এক্ষেত্রে নির্বাচনের বাইরে থাকা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতার উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে বাধাগুলো অপসারণ করা উচিত। হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি এবং সহিংসতার পথ পরিহার করতে হবে বিরোধী দলগুলোকে। মনে রাখতে হবে, অস্থিরতার ফলে দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা দিলে সরকারকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। কাজেই সব বিরোধী দলকে আস্থায় এনে দেশ পরিচালনা করাই নতুন সরকারের জন্য সুবুদ্ধির পরিচায়ক হবে। বস্তুত জাতীয় নির্বাচনে বড় বিজয় দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। বিশেষত রিজার্ভ সংকট ও মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য বড় সংকট সৃষ্টি করেছে। দ্রব্যমূল্য কমিয়ে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে দেওয়া নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে মনে করি। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশে সর্বব্যাপী দুর্নীতি দমন করা হবে নতুন সরকারের আরেকটি বড় দায়িত্ব। বস্তুত দুর্নীতি দেশের অর্থনীতির বর্তমান নাজুক অবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। দুর্নীতির লাগাম টানা না গেলে নতুন সরকারকে পদে পদে সংকটে পড়তে হবে। নতুন সরকার দেশ ও জনগণের স্বার্থে অবিলম্বে এসব ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এটাই প্রত্যাশাই করি আমরা।

শেখ হাসিনা ছাড়াও বিশ্বের আরও যেসব নেতা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন আছেন, তাদের নিয়ে গত বছরের মাঝামাঝিতে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক স্বাধীন, নির্দলীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিবিষয়ক থিংক ট্যাংক লোই ইনস্টিটিউট। সেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের নাম রয়েছে। ৭০ বছর বয়সি হুন সেন কম্বোডিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন ৩৮ বছর। গত বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয় পেয়ে ছেলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার এই তালিকায় আরও রয়েছে ব্রুনাইয়ের সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, গিনির প্রেসিডেন্ট তেওডোরো ওবিয়াং এনগুয়েমা এমবাসোগো, ক্যামেরুনের পল বিয়া, উগান্ডার ইওওয়েরি মুসেভেনি এবং আফ্রিকার কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ডেনিস সাসু এনগুয়েসো। ইরিত্রিয়ার ইসাইয়াস আফওয়ারকি এবং রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামে এ তালিকায় রয়েছেন। আরও রয়েছেন পূর্ব ইউরোপের দেশ বেলারুশের আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো, তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমোমালি রহমান এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি। তবে সবাইকে ছাপিয়ে দেশ শাসনে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন শেখ হাসিনা। তার একটাই কারণ বাংলাদেশকে তিনি উন্নয়নের রোড মডেলে পরিণত করেছেন, যা দেখে বিস্মিত গোটা বিশ্ব।

১৫ বছর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন টানা চার মেয়াদের মধ্যে প্রথমবার ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখনো বিশ্ব ছিল অর্থনৈতিক মন্দায়। এর সুফল পেয়েছিল বাংলাদেশ। এর আগের দুই বছর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার খাদ্যের দাম নিয়ে মহাসংকটে ছিল। কিন্তু যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তত দিনে পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ার সুফল পেয়েছিল বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশগুলো। এতে খাদ্যের দাম কমে যায়। হ্রাস পায় মূল্যস্ফীতির চাপ। ফলে নতুন সরকারের সামনে বড় কোনো সংকট ছিল না; বরং দায়িত্ব নিয়েই ডিজেল ও সারের দাম কমানো হয়। এতে লাভবান হন বোরো ধানের কৃষকেরা। ২০১৪ সাল অবশ্য অতটা মসৃণ ছিল না। বিশেষ করে টানা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতে অর্থনীতির ক্ষতি ছিল ব্যাপক। ফলে বিনিয়োগ নিয়ে আশঙ্কাই ছিল বেশি। তবে সহিংসতায় ক্ষতি হয়েছে- এই সুযোগ নিয়েই শুরু হয়েছিল খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার মহোৎসব। এরই মধ্যে অর্থনীতি দেখে ফেলেছে বড় বড় অনেক ঋণ কেলেঙ্কারি। হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ঘটে প্রথম মেয়াদেই। পরের পাঁচ বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঠিকই, একই সঙ্গে দুর্বল হয়েছে আর্থিক খাত। 

নতুন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের নাম অর্থনীতি। আর এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। কাজটি কতটা পারবেন, সেটাই এখন প্রশ্ন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর যখন টানা তৃতীয়বার দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগ, তখনো উচ্চ প্রবৃদ্ধি ছিল। কিন্তু ব্যাংক খাতের অবস্থা হয়ে পড়ে আরও নাজুক-আর্থিক কেলেঙ্কারিও বেড়ে যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটে, খেলাপি ঋণ ছাড়িয়ে যায় এক লাখ কোটি টাকা।  তবে সব সময়কে ছাড়িয়ে গেছে এবার। এখন অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকই নিম্নমুখী। সংকট সব ক্ষেত্রেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ভাষায়, অর্থনীতি এখন তলানিতে। সেই তলানি থেকে অর্থনীতিকে তুলে আনাই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আর অর্থনীতি তলানিতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সংকটের পাশাপাশি সরকারের ভুল নীতিও অনেকখানি দায়ী।  সুতরাং টানা চতুর্থ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জের তালিকাটাও বেশ দীর্ঘ। প্রথমত, সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে হবে। এ জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো ও ডলারের বিনিময় হারকে স্থিতিশীল করা। এগুলো করতে পারলেই বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরবে। এরপরের কাজ হচ্ছে অর্থনীতিকে আবার প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরিয়ে আনা। এ জন্য সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ যে উচ্চ প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করতে পেরেছিল, তার প্রধান কারণ সামষ্টিক অর্থনীতি ছিল স্থিতিশীল। অথচ সেটাই এখন হুমকির মধ্যে।  চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষ। বাকি আছে আর ছয় মাস। সরকারের আরেক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই ছয় মাসের অর্থনীতি মেরামত। গতানুগতিক পথে এই সংকট মিটবে না। তাই আগামী বাজেট পর্যন্ত অর্থনীতির জন্য বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেওয়া প্রয়োজন। আর সেটাই বেসরকারি খাত ও উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে ইতিবাচক বার্তা দেবে।এটা ঠিক যে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি গিয়েছিল। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ছিল উচ্চ প্রবৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতি বেশির ভাগ সময় ৫ শতাংশের আশপাশে ছিল। কিন্তু এসব সূচক এখন অতীত; বরং অতীতের তিনটি সূচক অর্থনীতিকে এখনো বিপদে রেখেছে। যেমন সর্বনিম্ন কর-জিডিপি অনুপাত, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা এবং সুদহার ৯-৬ রাখা। এরপর সংকট শুরু হলে তা অস্বীকার করার প্রবণতা। এমনকি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতিকেও ব্যবহার করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি বজায় রাখা হয় ডলারের চারটি হার। এতে অবৈধ পথে ডলার কেনাবেচার পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়।  দেশে মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ে ঘাটতির কারণে ডলারের দর বেড়েছে, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে ক্রমেই কমছে রিজার্ভ, যা এখন ২০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩৮ কোটি ডলার। আর প্রকৃত বা নিট রিজার্ভ ধরলে তা ১৬ বিলিয়ন ডলারের কম। অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ২ দশমিক ৯১ শতাংশ, আর রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি আরও কম—মাত্র দশমিক ৮৪ শতাংশ। এ সময়ে আমদানি কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যে সবচেয়ে বড় অস্বস্তির নাম আর্থিক হিসাবের ঘাটতি, যা ৫৪০ কোটি ডলার।
রাজনৈতিক অবস্থা, একতরফা নির্বাচন, মানবাধিকার পরিস্থিতি, আদালতে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শাস্তি- এর কোনো কিছুই বিদেশে বাংলাদেশ নিয়ে ভাবমূর্তি আগের চেয়ে ইতিবাচক হয়নি। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার অবস্থায়ও বাংলাদেশ নেই। সুতরাং ভরসা হচ্ছে কয়েকটি দেশ থেকে নেওয়া সরবরাহকারী ঋণ ও সংস্কার করতে পারলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বহুজাতিক সংস্থার ঋণ। আর দেশের মধ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দূর করতে হবে ডলার ও জ্বালানির সংকট। কমাতে হবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার খরচ। এ কাজে গত ১৫ বছরে সরকার খুব একটা সফল হয়নি। সুতরাং এই চ্যালেঞ্জ দীর্ঘদিনের। আগামী অর্থবছর থেকে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে এই চ্যালেঞ্জ সরকারকে নিতেই হবে।

জাতীয় সংসদে এখন ব্যবসায়ীদের আধিক্য। ২০০৮-এর নির্বাচনে সংসদে ব্যবসায়ীদের হার ছিল ৫৭ শতাংশ। পরের দুই মেয়াদে ছিল যথাক্রমে ৫৯ ও ৬২ শতাংশ। আর এবার তা আরও বেড়ে হয়েছে ৬৭ শতাংশ। এতে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী ক্রমান্বয়ে ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে। শুল্ক ছাড় থেকে শুরু করে ব্যাংকের নীতি বদলসহ নানা বিষয়ে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন তাঁরা। অথচ বিনিয়োগের পরিবেশ ভালো করার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান সামান্য। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা কমানোর উদ্যোগেও অগ্রগতি খুবই কম। ফলে বিনিয়োগের বাধা রয়েই গেছে। 
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। সেই খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) হিসাব করে বলছে, গত ১৫ বছরে আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে লুটপাট হয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে। দেশের ব্যাংক খাত এখন পরিণত হয়েছে অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্র হিসেবে। আর প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে ব্যাংক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি হয়ে পড়েছে দুর্বল। নতুন মেয়াদে সরকারের জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে নানা ধরনের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে সামলানো, যাতে রাহুমুক্ত হয় ব্যাংক খাত। দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংক খাত নিয়ে একটি কমিশন গঠনের সুপারিশ করে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সেটাও করা প্রয়োজন মনে করছেন তাঁরা।

রিজার্ভের ক্রমাগত পতনের মুখে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে সরকার। এর দুটি কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। নতুন বছরে আরও দুই কিস্তি ঋণ পাওয়ার কথা। এ জন্যও সংস্কার করতে বাধ্য সরকার। এর মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের করছাড় কমানো, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা, ভর্তুকি হ্রাস, খেলাপি ঋণ কমানো, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের তালিকা নিয়মিত প্রকাশ করা, ব্যাংক খাতের তদারকিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন, নীতি সুদহারের কাঠামো ঠিক করা; রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ঝুঁকি কমানো ইত্যাদি।  আরও বেশ কিছু খাতে সংস্কার করতে হবে। যেমন সরকারের ঋণ নেওয়ায় নিয়ন্ত্রণ আনা, সরকারি ব্যয়ের গুণমান বাড়ানো, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়া, পুঁজিবাজারকে স্বচ্ছ করা ইত্যাদি। সুতরাং বাস্তবায়ন করতে হবে, এমন কাজের তালিকা বেশ দীর্ঘ। ১৫ বছর ধরে বিশেষ একটি সুবিধাবাদী শ্রেণী গড়ে উঠেছে। তারাই এখন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। এ পরিস্থিতিতে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।

আধুনিক রাষ্ট্রের ভাগ্যবিধাতা শাসকরাও নয়, জনগণও নয়। এ রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ স্বার্থের গোষ্ঠীসমূহ। অর্থনীতিবিদ অলসন এসব গোষ্ঠীকে আখ্যায়িত করেছেন “বণ্টনমূলক জোট”। এদের উদ্দেশ্য সমাজের কল্যাণ নয়, আত্মকল্যাণ; এরা উৎপাদন বাড়াতে চায় না, বণ্টনব্যবস্থায় নিজেদের বখরা বড় করতে চায়। এ ধরনের স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের জোট, পেশাদারদের সমিতি এবং কর্মচারী ও শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন। যে কোন সংস্কার প্রবর্তিত হলেই কোন না কোন বণ্টনমূলক জোটের স্বার্থ হুমকির সম্মুখীন হয়। কোন গোষ্ঠীই তাদের স্বার্থের ব্যাপারে আদৌ কোন আপোষ করতে রাজি নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় লেনিনগ্রাডের রণক্ষেত্রে রুশ সৈন্যরা দেশমাতৃকার জন্য যে আবেগ ও ঐকান্তিকতা নিয়ে যুদ্ধ করেছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি হিংস্রতা নিয়ে সংস্কারের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে কায়েমী স্বার্থবাদীরা। বাংলাদেশের অবস্থা এখন এ রকমই। ফলে আইএমএফের শর্ত মেনে সংস্কার করা সহজ হবে না। যেমন, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরপরই বলে দিয়েছেন যে আইএমএফের শর্ত মেনে রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় যাঁরা এত দিন ধরে করছাড় পেয়ে আসছেন, খেলাপি ঋণ বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন, ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, সংস্কারের প্রধান প্রতিবন্ধকতা তাঁরাই। এত দিন অর্থনীতিতে মূল নীতি নির্ধারকের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরকে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিজের কাজটি ভালোভাবে করতে হবে। সারা বিশ্বেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। জবাবদিহিসহ এই কাজ তারা ভালোভাবে করতে পারবে, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই বড় চ্যালেঞ্জ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হঠাৎ হঠাৎ নতুন নতুন পণ্যের দর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া ঠেকানো।এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। নতুন সরকারকে এ বিষয়ে প্রাধান্য দিতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন সরকারকে শিল্প ও কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়াতে হবে, যাতে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকে। কৃষি উৎপাদন বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না। সুতরাং বাজার তদারকি বাড়াতে হবে ও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। আমদানি কিংবা খুচরা পর্যায়ে যাতে সিন্ডিকেট না হয়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। গত এক-দেড় বছরে ডলারের দাম ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এতে আমদানি মূল্যও বেড়েছে। এতে রাজস্ব আদায় বেড়েছে। সুতরাং এখন শুল্ক কমানোর সময় হয়েছে। এ ছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ আনা বন্ধ করে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ আনায় বেশি জোর দিতে হবে। খেলাপি ঋণ বিচার-বিশ্লেষণ করতে একটি কমিটি করা যেতে পারে। কেন খেলাপি ঋণ বাড়ছে, তা খুঁজে বের করতে ‘কেস টু কেস’ ভিত্তিতে বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত। ঋণ খেলাপি হওয়ার পেছনে কিছু যৌক্তিক কারণ থাকে। আবার কিছু ঋণ খেলাপি হওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণ নেই। ওই টাকা দেশে আছে নাকি বিদেশে খরচ হয়েছে, তা দেখতে একটি কমিটি গঠন প্রয়োজন।

নতুন মন্ত্রিসভার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, এর বড় অংশের অভিজ্ঞতার ঘাটতি ও দুর্বলতা রয়েছে। আওয়ামী লীগের নতুন সরকারের মন্ত্রিসভার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। নতুন মন্ত্রিসভা ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কতটা সক্ষমতা দেখাতে পারবে, সে বিষয়টিই এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। টানা চতুর্থ দফায় আওয়ামী লীগের নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জের মধ্যে বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলানো এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। নতুন-পুরোনো মিলিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা হলেও অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকবে। এর পেছনে তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, পুরোনোদের মধ্যে ৩০ জন মন্ত্রী বাদ পড়েছেন। কিন্তু পুরোনোদের বড় অংশ মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। নতুন ১৪ জন প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় যুক্ত হয়েছেন। এর সঙ্গে অর্থ, বাণিজ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সামলে নির্বাচনী ইশতেহার বা অঙ্গীকার বাস্তবায়নে দুর্বলতা ও যোগ্যতার প্রশ্ন আসতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এর আগে চারবার সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি বন্ধ করা, বৈশ্বিক পরিস্থিতিসহ চ্যালেঞ্জগুলোকে আওয়ামী লীগের নতুন সরকার মোকাবিলা করেই এগোতে পারবে। মন্ত্রিসভার সদস্যদের অনেকের অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকতে পারে। কিন্তু অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয়টি নির্ভর করে দলনেতা ও সরকারের কৌশলের ওপর। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে অভিজ্ঞতার ঘাটতি বা দুর্বলতা থাকলে সরকার সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। দ্রব্যমূল্য সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, কর্মসংস্থান বাড়ানোসহ ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ দলটির নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে বাণিজ্য, অর্থ, পরিকল্পনা ও কৃষিসহ যে মন্ত্রণালয়গুলো প্রধান ভূমিকা পালন করবে, সেসব মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ একটা অবস্থান নেয়। ফলে তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। এমন পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার ও দলকে আলাদা করার একটা আলোচনা ছিল আওয়ামী লীগে। বিদায়ী মন্ত্রিসভায় এর প্রভাব ছিল। কিন্তু এখন মনে করা হচ্ছে সামনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে। এ জন্য দলের সক্রিয় রাজনীতিকদের এবার কিছুটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে দলের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকা কিছু কিছু নেতাকেও পুরস্কার হিসেবে এবার সরকারে নেওয়া হয়েছে। নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। এবারের মন্ত্রিসভা নিয়ে খুবই আশাবাদী বা একেবারে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সততা, দক্ষতা ও কাজের মাধ্যমেই মন্ত্রিসভার সদস্যদের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।







আরও খবর


প্রকাশক: এম এন এইচ বুলু
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মাহফুজুর রহমান রিমন  |   উপদেষ্টা সম্পাদক : রাজু আলীম  
বিএনএস সংবাদ প্রতিদিন লি. এর পক্ষে প্রকাশক এম এন এইচ বুলু কর্তৃক ৪০ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, বুলু ওশেন টাওয়ার, (১০তলা), বনানী, ঢাকা ১২১৩ থেকে প্রকাশিত ও শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
ফোন:০২৯৮২০০১৯-২০ ফ্যাক্স: ০২-৯৮২০০১৬ ই-মেইল: spnewsdesh@gmail.com