শিরোনাম: |
করোনা মহামারীর বিপর্যয় থেকে দেশের অর্থনীতি পুনরু"ারকল্পে সরকারের দেওয়া বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ এবং ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ শ্রেণিকরণসহ অন্যান্য সুবিধা নিয়ে মহামারীর পুরো সময় ধরেই নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তবে, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ এবং অন্যান্য পদক্ষেপ যে দেশের অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখতে বিশেষ ভ"মিকা রেখেছে সেটা অনস্বীকার্য। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি জানিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃ"ি হতে পারে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। মহামারীর প্রায় দুই বছরেও দেশের প্রবৃ"ি অব্যাহত থাকা এবং অন্যান্য সূচকে অগ্রগতি থেকে সেটা স্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে যে, সরকারের এসব সহায়তাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়ী ও বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং দেশের শ্রমঘন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও অন্যান্য খাতের উদ্যোক্তা ও কর্মীদের সহায়তাপ্রাপ্তিতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ফারাক রয়ে গেছে। গত সোমবার গণমাধ্যমে 'আরও ছয় মাস করোনা ছাড় চায় ব্যবসায়ীরা' শিরোনামের প্রতিবেদনে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংঠন এফবিসিসিআই-এর ঋণ শ্রেণিকরণ সুবিধা দাবির কথা তুলে ধরা হয়। উল্লেখ্য যে, ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা মহামারীর বিস্তার ঘটলে ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে কিস্তি পরিশোধে বড় ধরনের ছাড় দেওয়া হয়। পরে করোনার ভয়াবহতা বাড়তে থাকলে এই ছাড়ের মেয়াদও বাড়ানো হয়। ফলে ওই বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত থাকতে পেরেছেন ব্যবসায়ীরা। চলতি বছরের শুরুতে এই ছাড় তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিলেও ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে শর্তসাপেক্ষে ছাড়ের মেয়াদ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাৎ মহামারীর শুরু থেকে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই বছর ব্যবসায়ীরা এই সুবিধা ভোগ করছেন। কিন্তু তারা বলছেন, অর্থনৈতিক কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ভয়াবহ সংকটে রয়েছেন। এ কারণে উপরোক্ত ঋণ শ্রেণিকরণ সুবিধা ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আরও ছয় মাস বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংঠন এফবিসিসিআই। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংককে যত দ্রুত সম্ভব ঋণ শ্রেণিকরণ সুবিধার মেয়াদ বৃ"ি সংক্রান্ত ঘোষণা দেওয়ার আহ"ান জানিয়েছেন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন। অবশ্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই ছাড়ের ফলে ব্যবসায়ীরা যেমন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন, তেমনি ব্যাংকগুলোও লোকসানের হাত থেকে বেঁচেছে। ঋণগুলো খেলাপি হয়ে পড়লে ব্যাংকগুলোকে এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হতো। ঋণও আদায় হতো না। তবে এখন ব্যাংকগুলো এই ছাড়ের কারণে ঋণ নিয়মিত রেখে উল্টো সুদ আয় খাতে দেখাতে পারছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো ভালো মুনাফাও দেখাতে পারছে। এর বিপরীতে এই আলোচনাও প্রয়োজন যে, ঋণ শ্রেণিকরণ সুবিধাপ্রাপ্ত বড় ব্যবসায়ীরাই প্রণোদনা ঋণের বড় গ্রহীতা। লক্ষ করা দরকার, মহামারীকালে দেশের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য যে ঋণ প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হয়েছিল তার ধরন ছিল চলতি মূলধন, যা দিয়ে দৈনন্দিন খরচ মেটানোর কথা। ঐ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও বলেছিল, এই প্রণোদনার ঋণের টাকায় অন্য ঋণ শোধ করা যাবে না। কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় প্রদত্ত ঋণ যথাযথ খাতে ব্যবহার না হয়ে কিছু কিছু অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ঋণ দিয়ে ঋণগ্রহীতার অন্য কোনো ঋণের দায় সমন্বয় করা হচ্ছে। এছাড়া মঞ্জুরিকৃত ঋণের টাকা ছাড়ের ক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যাংক সময়ক্ষেপণ করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, কভিড-১৯-এর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, যেগুলোর মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। এরপর সরকার চলতি বছরের জুলাই মাসে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার আরও পাঁচটি প্যাকেজ ঘোষণা করে। সব মিলিয়ে মোট প্যাকেজের সংখ্যা ২৮ এবং বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম দফায় ঘোষিত ২৩টির মধ্যে ৫টি প্যাকেজের বাস্তবায়নের হার খুবই শোচনীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় এসএমই খাতে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার কোটি টাকা, খরচ হয়েছে মাত্র ২৯ কোটি টাকা, শতকরা হিসাবে ২ শতাংশের কম। ফলে শ্রমঘন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন এ খাতে নিয়োজিত লাখ লাখ শ্রমিক। দেখা গেছে ব্যাংকগুলোও বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যতটা উৎসাহী, ছোট অঙ্কের ঋণ দিতে ততটা নিরুৎসাহী। এমতাবস্থায়, মহামারীকালের বর্তমান বাস্তবতায় কোন কোন খাতে এখনো বেশি সমস্যা রয়ে গেছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে সবার আগে সেসব চিহ্নিত করা জরুরি।