ইসলামে আংটি পরা শুধু অলঙ্কার নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর বংশধর তথা আহলে বাইতের সদস্যদের জীবনে আংটির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
বহু হাদিসে রুপার তৈরি আংটি, বিশেষ করে মূল্যবান পাথরযুক্ত আংটি পরার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে— রুপার আংটি বরকত আনে, বিপদ থেকে রক্ষা করে, এমনকি অন্তরকে আলোকিত করে।
প্রতিটি পাথরের রয়েছে নিজস্ব আধ্যাত্মিক বার্তা। যেমন—লাল আকিক সাহস ও হেফাজতের প্রতীক; ফিরোজা মানসিক প্রশান্তি ও সফলতার বার্তা বহন করে; কালো হাজরে আসওয়াদ পবিত্রতা ও আনুগত্যের স্মারক। সবুজ পাথরের আংটি, বিশেষত সবুজ আকিক, ইসলামি ঐতিহ্যে প্রতিরোধ ও আধ্যাত্মিক স্থিরতার প্রতীক।
এই ঐতিহ্য আর সুন্নাতকে জীবন্ত রেখেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনি। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, ধর্মীয় সমাবেশ কিংবা সাধারণ জনসভার কোনো বক্তৃতা—সবখানেই তাঁর হাতে দেখা যায় এমন আংটি, যা নিছক অলঙ্কার নয়, বরং একটি বার্তাবাহী চিহ্ন। বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি ভিন্ন ভিন্ন পাথরের আংটি ব্যবহার করেন, যার প্রতিটির পেছনে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক প্রতীকী অর্থ।
নিঃশব্দ বার্তা, দৃশ্যমান আস্থা
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির হাতে কখনো লাল, সবুজ ও হলুদ আকিক, কখনো হালকা নীল বা কালো পাথরের আংটি দেখা যায়। তাঁর প্রতিটি আংটি বেছে নেওয়া হয় পাথরের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব বিচার করে।
গত ১৫ জুলাই খামেনির ডান হাতে একটি আংটিতে দেখা যায় পবিত্র কুরআনের সুরা আশ-শুআরার ৬২ নম্বর আয়াত। এতে গাঢ় লাল আকিক পাথরে খোদাই করে লেখা হয়েছে: إِنَّ مَعِيَ رَبّي سَيَهْدِينِ
অর্থ: “কখনই না! নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালক আমাদের সঙ্গে আছেন; তিনি শিগগিরই আমাদের পথ দেখাবেন। ”
এই আয়াতটি ছিল ফেরাউনের সৈন্যদের মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তে হজরত মূসা (আ.)-এর দৃঢ় বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। এই আয়াতযুক্ত আংটি যেন খামেনির নিজের আদর্শ ও রাজনৈতিক অবস্থানের মৌলিক বার্তা— ‘বিপদের মাঝেও ভেঙে পড়ো না, কারণ আল্লাহ পথ দেখাবেন’।
এ প্রসঙ্গে ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর খামেনির দেওয়া একটি বক্তৃতার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সে সময় তিনি বলেছিলেন: “আল্লাহর ওপর ভরসা ও বিশ্বাস রেখে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান পৃথিবীর কোনো শক্তিরই ভয় করে না। যদি দুর্বল মানসিকতাসম্পন্ন কেউ বনি ইসরাইলিদের মতো বলে বসে— ‘আমরা তো ধরা পড়ে গেছি! এখন শত্রুরা এসে আমাদের সর্বনাশ করবে!’ তবে আমরাও হযরত মূসা (আ.)-এর মতো বলব— “কখনই না! নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালক সঙ্গে আছেন; তিনি শিগগিরই আমাদের পথ দেখাবেন। ”
যখন আংটি হয়ে ওঠে উত্তরাধিকার
আয়াতুল্লাহ খামেনি প্রেসিডেন্ট, সামরিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শনার্থী, নবদম্পতি, ক্রীড়াবিদ এমনকি শিশুদেরকেও আংটি উপহার দিয়ে থাকেন। অনেক সময় নিজের আংটি খুলে উপহার দেন। যারা উপহারের আংটি পেয়েছেন, তাদের কাছে এটি এক নিঃশব্দ শপথ, এক গুরু দায়িত্বের স্মারক।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কুদস ফোর্সের প্রধান শহীদ জেনারেল কাসেম সোলেইমানি আজীবন আয়াতুল্লাহ খামেনির দেওয়া লাল আকিক পাথরের আংটি পরতেন।
২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি, বাগদাদ বিমানবন্দরে এক মার্কিন ড্রোন হামলায় যখন তাঁর দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন সবার আগে তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল সেই আংটির মাধ্যমেই। আংটিটি যেন নীরবে বলে যাচ্ছিল—“তুমি কেবল একজন সেনানায়ক নও, তুমি এখন ইসলামি বিপ্লবের নেতৃত্বের আদর্শের উত্তরাধিকারী”।
২০২৪ সালের ১৯ মে, এক মর্মান্তিক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি শহীদ হন। বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার হয় একটি নীল আকিক পাথরের আংটি— যা ছিল খামেনির উপহার।
ওই আংটিটি ছিল রায়িসির প্রতি খামেনির আস্থা ও নেতৃত্বের স্বীকৃতি। মৃত্যুর মুহূর্তেও সেই আংটি যেন সাক্ষ্য দিয়ে গেল— “তুমি আমার প্রতিনিধি ছিলে। আমার আস্থার উত্তরাধিকার। ”
২০০০ সালে ইসরায়েলি সেনাদের লেবানন ত্যাগ করার পরপরই হিজবুল্লাহ নেতা সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহকে একটি সবুজ আকিক পাথরের আংটি উপহার দেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। আংটিটি পরবর্তীতে ১৬,০০০ ডলার দামে নিলামে বিক্রি হয় এবং সেই অর্থ ব্যবহার হয় লেবানন ও গাজার মানুষের সাহায্যে। এই উপহার শুধু আবেগ নয়, বরং প্রতিরোধ ও সহমর্মিতার এক প্রাতিষ্ঠানিক প্রতীক হয়ে ওঠে।
একটি আংটি—এক নিঃশব্দ বিপ্লব
আজকের বিশ্বরাজনীতিতে পদক ও প্রতীক অনেক সময় বাহ্যিকতার অংশ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু খামেনির আংটি ভিন্ন। একটি পাথর—যা একসময় ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ—আজ তা একজন নেতার হাতে হয়ে উঠেছে আত্মিক বিপ্লবের নিদর্শন। না কোনো প্রচার, না কোনো শোরগোল— তবুও এই আংটির মধ্যে নিহিত রয়েছে এক গভীর বার্তা: “নেতৃত্ব শুধু পদ নয়, এটি হলো এক আধ্যাত্মিক দায়িত্ব। এক নিঃশব্দ শপথ। ”