প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই দশক হতে চললেও এখনো দূর হয়নি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আবাসন সংকট। পুরান ঢাকার ক্যাম্পাসে মাত্র একটি ছাত্রীহল নির্মিত হয়েছে, যাতে এক হাজার ২০০-এর মতো ছাত্রীর আবাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত নির্মিত হয়নি নতুন কোনো ছাত্রহল।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সত্তরের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে অন্তত ১১টি হল ছিল। তবে এসব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জমিতে ছিল না। বেশিরভাগই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে পাড়ি জমানো হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিত্যক্ত কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে যাওয়া সম্পত্তি। তবে নব্বইয়ের দশকের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে এসব হল থেকে ছাত্রদের উৎখাত করে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা। পরে সেগুলো দখল করে মার্কেট, স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলে বসে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্রে জানা যায়, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনটি হল রয়েছে। সেগুলো হলো ওয়ারীতে অবস্থিত শহীদ নজরুল ইসলাম হল, বংশালে অবস্থিত ড. হাবিবুর রহমান হল এবং সূত্রাপুরে অবস্থিত বাণী ভবন। এসব হলের জায়গায় নির্মিত হয়নি নতুন কোনো স্থাপনা। বহু বছর আগে নির্মিত জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনই এখন পর্যন্ত সেখানে বিদ্যমান।
এর মধ্যে শহীদ নজরুল ইসলাম হলের ভবনে মাত্র ১৪ জন ছাত্র থাকেন। তারা নিজেদের মতো করেই সেখানে থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো দেখভাল সেখানে নেই।
বংশালের ড. হাবিবুর রহমান হলে কোনো ছাত্র থাকেন না। এখানে ৪০ জনের মতো কর্মচারী নিজেদের মতো করে থাকেন। ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর এটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে বুঝিয়ে দেয় সরকার। হলটি মোট ৯ দশমিক ৩৯ কাঠা জমির ওপর অবস্থিত।
অন্যদিকে সূত্রাপুরের বাণী ভবনে ৩০ থেকে ৩৫ জন কর্মচারী বসবাস করেন। জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ এই হলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন তারা। ১৯৫৪ সাল থেকে এটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই হলের মোট জমির পরিমাণ ১০ দশমিক ০৯ কাঠা।
এসব পুরাতন হলের স্থানে নতুন ভবন নির্মাণ করে ছাত্রদের আবাসন সংকট নিরসনের চিন্তাভাবনা করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবিতে যমুনা ঘেরাও আন্দোলনের পর এ উদ্যোগ গতি পেয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এই তিনটি হলের কোনোটিই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে দলিল করা সম্পত্তি নয়। এগুলো মূলত ‘অর্পিত সম্পত্তি’। সরকার এগুলোর দেখভাল করে থাকে। সে হিসেবে এই তিনটি হল সরকার থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে ইজারা দেওয়া হয়। তবে যেহেতু এসব সম্পত্তি সরকারের অধীনেই রয়েছে, সেহেতু এসব জায়গায় হল নির্মাণে কোনো বাধা নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা তিনটি হলের মধ্যে শহীদ নজরুল ইসলাম হলের জমি সীমিত। এজন্য সেখানে নতুন হল নির্মাণের পরিকল্পনা নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। এক্ষেত্রে ড. হাবিবুর রহমান হল ও বাণী ভবনের স্থানে নতুন ছাত্রহল নির্মাণের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
হল নির্মাণের লক্ষ্যে হাবিবুর রহমান হল এবং বাণী ভবনে ইতোমধ্যে প্রাথমিক অ্যাসেসমেন্ট ও মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছে সেনাবাহিনী। এই দুই হল বসবাসের অযোগ্য ও পরিত্যক্ত। রাজউক থেকে এই দুইটি ভবনে বসবাস করতে নিষেধাজ্ঞা দিলেও সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মচারী। দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (আরডিপিপি) সঙ্গে এ দুটি হলের নির্মাণ কাজ করবে সেনাবাহিনী। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়।
গত ২৮ মে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশোধিত দ্বিতীয় ক্যাম্পাস প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রকল্পের সরকারি আদেশ (জিও) ইস্যু করেছে।
এ ব্যাপারে সেনাবাহিনী থেকে নিযুক্ত প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইফতেখার আলম জানান, দৃশ্যমান কাজে যাবে সেনাবাহিনী। আমরা জায়গা পরিদর্শন করেছি আগেই।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. শহিদুল্লাহ জানান, ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে আমাদের এসব হলের জমিতে নতুন ভবন করার স্থায়ী অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে প্রতি বছর জমির লিজ নবায়ন করতে হবে। মূলত হলের জমিগুলো ডিসি অফিস থেকে একসনা লিজ নেওয়া। লিজ প্রতিবছর নবায়ন করার নিয়ম থাকলেও বিষয়টি এমন নয় যে, জমি আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। এজন্য এসব স্থানে হল নির্মাণে কোনো বাধা নেই।
এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা ড. হাবিবুর রহমান হল ও বাণী ভবনের স্থানে ছাত্রহল নির্মাণের পরিকল্পনা করছি। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’
বহুতল ভবন নির্মিত হবে নাকি অস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে এ প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, অস্থায়ী নয়, স্থায়ী ভবন নির্মাণ করা হবে। সেক্ষেত্রে ছয়তলা ভবন নির্মাণ করা হতে পারে।
এছাড়া কেরানীগঞ্জে নির্মাণাধীন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ একরের ক্যাম্পাসের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে কেনা সাত একর জমিতে তৈরি করা হবে অস্থায়ী আবাসন। নিচে পাকা ও উপরে টিনশেড করে এ অস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। এখানে দুই সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। এ লক্ষ্যে ১ জুন ওই জমিতে বালু ভরাটের কাজ উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ড. রিফাত হাসান বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ইউজিসির অর্থায়নে অস্থায়ী আবাসন তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এ আবাসন তৈরি করা হবে কেরানীগঞ্জে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা সাত একর জমির ওপর।
কবে এ অস্থায়ী আবাসন তৈরির কাজ শেষ হবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. তাজাম্মুল হক বলেন, আমরা এখন বালু ভরাটের কাজ শুরু করেছি। এটা শেষ করতে মাস দুয়েক লেগে যাবে। এরপর দ্রুতই আমরা মূল স্ট্রাকচার তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করবো।