শেরপুর সীমান্তের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য গত তিন বছরেও মেলেনি নিজ ভাষার বই। নিজ ভাষায় পাঠদানের জন্য স্কুলে নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষক। নিজেদের ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ না থাকা এবং পরিবারে ভাষা চর্চা কমে যাওয়ায় বিলুপ্তির পথে এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা। তাই ভাষাচর্চা ও সংরক্ষণে সরকারের সহযোগিতা চান স্থানীয়রা।
শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় সাতটি সম্প্রদায়ের প্রায় ৫৪ হাজার মানুষের বসবাস। এর মধ্যে গারো, বর্মণ ও হদি সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যাই বেশি। সম্প্রতি সরকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করলেও তা এখনো এই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছায়নি। গেল তিন বছর ধরে স্থানীয় বিদ্যালয় থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার শিক্ষার্থীদের বইয়ের চাহিদা ঢাকায় পাঠানো হলেও বই আসেনি শেরপুরে। সর্বশেষ চলতি ২০২৩ শিক্ষাবর্ষেও প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৪৯০ জন শিক্ষার্থীর জন্য বইয়ের চাহিদা পাঠানো হলেও এখনো তা পৌঁছায়নি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলতি শিক্ষাবর্ষে শেরপুর জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৯০ জন। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে রয়েছে ১৪০ জন, প্রথম শ্রেণিতে ১২০ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১১৫ জন এবং তৃতীয় শ্রেণিতে ১১৫ জন। এর বাইরেও অন্যান্য শ্রেণিতে প্রায় আরও পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৪৯০ জনের জন্য বইয়ের চাহিদা দেওয়া হলেও এখনো তা শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছায়নি।
এদিকে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই প্রশিক্ষিত শিক্ষকও। যার ফলে এসব শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষাতেই শিক্ষাগ্রহণ করতে হচ্ছে।

ঝিনাইগাতী উপজেলার 'আপন শিক্ষা পরিবার'-এর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী প্রদীপ কোচ বলেন, “আমরা বাংলা ভাষাতেই পড়াশোনা করি। বাংলাতেই আমাদের পড়তে হয়। ক্লাসের বাইরেও খুব একটা নিজেদের ভাষায় কথা বলা হয় না। তাই আমাদের ভাষাটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।”
শিক্ষক নিধারঞ্জন কোচ বলেন, “পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ ভাষায় বই পড়ে। কিন্তু আমাদের এলাকায় এখনও সেই বই পৌঁছায়নি। আমরা বহুবার বই চেয়ে তাগিদ দিয়েছি। শিক্ষা কর্মকর্তারাও চাহিদা দিয়েছেন। তারপরও বই কেন আসছে না, তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমাদের ভাষা চর্চা ও সংরক্ষণের জন্য বই খুবই জরুরি। পাশাপাশি প্রয়োজন প্রশিক্ষিত শিক্ষক।”
শুধু পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক সংকট নয়, আধুনিকতার প্রভাবে পরিবারেও ভাষার চর্চা কমে যাওয়ায় দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা। হেপি হাজং বলেন, “সবার আগে পরিবারের শিক্ষাটা জরুরি। তারপর স্কুল আর পাঠ্যপুস্তক। কিন্তু এখনকার সময়ে পরিবারে ভাষার চর্চা একেবারেই কমে গেছে। তাই ভাষাগুলো দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।”
ব্রেমিং চিসিম বলেন, “আমরাও এখন নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষা ব্যবহার করি না। তাহলে বাচ্চারা শিখবে কী করে? তাই আমাদের নিজেদেরও সচেতন হওয়া উচিত।”
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা রক্ষায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বইয়ের পাশাপাশি প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানান স্থানীয় নেতারা।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্প (আইইডি) শেরপুরের ফেলো সুমন্ত বর্মণ বলেন, “বাংলা ভাষার আগ্রাসনের কারণেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এখনই সরকার যদি উদ্যোগ না নেয়, তাহলে এসব ভাষা টিকিয়ে রাখা যাবে না। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিটি স্কুলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক সরবরাহের বিকল্প নেই।”
শেরপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, “প্রতি বছরই বইয়ের চাহিদা দেওয়া হয়। কিন্তু কেন বই সরবরাহ হচ্ছে না, তা নিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো। দ্রুত সময়ের মধ্যে বই সরবরাহের বিষয়টি দেখা হবে। আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টিও ওপর মহলে জানানো হবে। আশা করি, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে।”
এনজিও আইইডির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শেরপুর জেলায় গারো ১৬ হাজার ৫০০, হাজং ৪ হাজার ৭০০, হদি ১০ হাজার ৬০০, বর্মণ ১৭ হাজার, কোচ ৩ হাজার ৫০০, ডালু ১ হাজার ১০০ ও বানাই ১১০ জন বাস করছেন। তাই সময়ের সঙ্গে যেন তাদের ভাষা হারিয়ে না যায়, সে বিষয়ে সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ চান শেরপুরের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাসিন্দারা।