প্রকাশ: শনিবার, ৩১ মে, ২০২৫, ১০:৫৭ PM
বাংলাদেশে দুর্নীতিকে অনেকেই "চালাকির" প্রতিভা মনে করে। যখনই কেউ সেই প্রতারণার শেকড়ে আঘাত করে, তখনই গর্জে ওঠে সুবিধাভোগীদের দল। ১২ মে ২০২৫—এই তারিখটি ইতিহাসে লেখা থাকবে, কারণ সেদিন সরকার এমন এক সিদ্ধান্ত নেয়, যা সত্যিকার অর্থেই দুর্নীতির দুর্গে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণে এনবিআরের নীতি ও ব্যবস্থাপনা পৃথকীকরণ অধ্যাদেশ জারির উদ্যোগ নেয় সরকার। এনবিআরের খসড়া বদলে কিছু প্রশাসন কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থে পরিবর্তন আনেন বলে রাজস্ব ভবনে আলোচনা শুরু হয়। বিষয়টি জানতে পেরে আয়কর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা প্রতিবাদ করেন। আংশিক পরিবর্তন হলেও সন্তুষ্ট না হয়ে কর্মকর্তারা ঐক্যবদ্ধ হন। এ সময় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল আন্দোলনে ঢুকে পড়লে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
এদিকে, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে এনবিআর চেয়ারম্যান বহু কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেন। পদোন্নতি বঞ্চিত, দুর্নীতিতে যুক্ত কিছু কর্মকর্তা আন্দোলনে সক্রিয় হন, চেয়ারম্যান অপসারণের দাবিও তোলেন। জুনিয়রদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে তাদের উদ্বিগ্ন করা হয়। অন্যদিকে, বড় দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে এনবিআর চেয়ারম্যানের জিরো টলারেন্স ও বিপুল অডিট-উদ্ধারে শত শত কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ে এক শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ক্ষুব্ধ হন। তারাও এই আন্দোলনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। কেন এত ভয়? কারণ এনবিআর আগে নিজেরাই কর নির্ধারণ করত, আবার নিজেরাই তা আদায় করত। আর এই স্ববিরোধী ক্ষমতার মাঝেই ছিল দুর্নীতির স্বর্ণখনি। ১০০ টাকার কর থেকে ২০ টাকা ঘুষ দিয়ে ৩০ টাকায় নিষ্কৃতি—বাকি ৭০ টাকা গিলে খেত এক সংঘবদ্ধ চক্র। এটি শুধু ক্ষতিই করত না, দেশজুড়ে সৎ ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করত এবং বৈধ আয়ের পথকে করাতের নিচে ফেলত। যখন ঘোষণা আসে, " দুর্নীতি করলে চাকরি থাকবে না"—তখন যেন নড়ে ওঠে পুরো প্রশাসনিক মহল। সচিবালয় পর্যন্ত আন্দোলনের আওয়াজ ওঠে। এ এক জ্বলন্ত প্রমাণ—যারা চিৎকার করছে, তারা নিজের দোষ ঢাকতে চায়। এ যেন বাংলা প্রবাদ "চোরেরও বড় গলা"-র জীবন্ত রূপ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে শুধু নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলেই হয় না, দরকার প্রশাসনিক দৃঢ়তা। আজ যখন সরকার সাহস করে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন জনতার সমর্থনই পারে তা বাস্তবায়ন করতে। এই মুহূর্তে যারা পথে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছে, তারা আদতে দেশকে নয়, নিজেদের 'উপার্জনের' পথ রক্ষা করতে নেমেছে। রাষ্ট্র যদি পিছিয়ে যায়, তাহলে আবার সেই আগের অন্ধকারেই আমরা ফিরব।
বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যান বাস্তবেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি জানেন, ছোট একটা পরিবর্তনও কীভাবে পুরো ব্যবস্থায় আলোড়ন তোলে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করে মাত্র ১০ মাসেই তিনি অতিরিক্ত ৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছেন। আগে যেখানে রিটার্ন জমা পড়ত মাত্র ৫ লাখ, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬.৪ লাখে। করদাতারা সার্কেলে না গেলে ঘুষের পথও বন্ধ। আর এই সাফল্যই আজ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মঞ্চ তৈরি করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে এখন যারা মাঠে নামছে, তারা কেউই সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। বরং তারা চায় যেন পুরনো পদ্ধতির ছত্রছায়ায় আবারো ঘুষের নদীতে ভেসে চলতে পারে। এই মুহূর্তে রাষ্ট্র যদি পিছিয়ে যায়, তাহলে এ যুদ্ধের পরাজয় হবে শুধু একজন কর্মকর্তার নয়—পুরো জনগণের। জাপানের এক বাসচালক মাত্র ৭ ডলার আত্মসাৎ করেছিল বলে তাকে চাকরিচ্যুত করে ৮৪ হাজার ডলার পেনশন কেটে নেওয়া হয়। বার্তাটি ছিল সোজাসাপ্টা—জনস্বার্থে আঘাত মানেই নিজের ভবিষ্যৎ ধ্বংস। আমাদের দেশেও এই নীতি অনুসরণ জরুরি। রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি মানে দেশের স্কুলে বই পৌঁছায় না, হাসপাতালের ওষুধ শেষ হয়ে যায়, দরিদ্র পরিবার পায় না খাদ্যসাহায্য। দুর্নীতির প্রতিটি টাকাই যেন গরিবের পেটে লাথি। এই মুহূর্তে সরকারকে শক্ত হতে হবে। জনতার সমর্থনও প্রয়োজন। যারা আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, তারা আসলে এক গভীর দুর্নীতির শেকড় বাঁচাতে মরিয়া। আর যে এনবিআর চেয়ারম্যান দুর্নীতির শেকড় কাঁপাচ্ছেন, তাঁকেই বরং আরও শক্তিশালী করা উচিত। আর আমরা, জনগণ, যদি এই মুহূর্তে নিরব থাকি, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।