বিগত সময়ে বহির্বিশ্বে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সামনে শেখ হাসিনা বিরোধী মিছিল-মানবন্ধন ও ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সামনে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীদের সঙ্গে সব সময় চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ করেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বিএনপির কর্মীদের গ্রামের বাড়িতে নির্মম অত্যাচার চালানো হয়। তারপরও থেমে থাকেনি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি।তারপরও ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র শাখা বিএনপির কমিটি হচ্ছে না। এ নিয়ে সেখানকার বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হামলা-মামলার রোষানলে পড়লেও তাদের নেই কোনো দলীয় পরিচয়। কমিটিবিহীন চলছে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির রাজনীতি। পদ-পদবি না পেয়েও অনেক নেতা-কর্মী ক্ষুব্ধ। দলীয় নানা কর্মসূচিও পৃথকভাবে পালন করছেন কেউ কেউ। এমন অবস্থায় বিগত দেড় দশকের ত্যাগ ও পরিশ্রমের মূল্যায়নের দাবি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা-কর্মীদের। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, বিগত ১৫টি বছর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করেছে। অথচ আজকে দীর্ঘ দিন ধরে কমিটি নেই। আমাদের নিজের পরিচয় দেয়ার মতো কোন জায়গা নেই। কমিটি না থাকায় দল দুর্বল হয়েছে। নিউইয়র্কের মতো জায়গায় সিটি কমিটি করে দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। এটা আমরা চাই না। আমরা দ্রুত একটা কমিটি চাই। যুক্তরাষ্ট্রের সকল বিএনপি এক ছাদের নিচে থাকতে চাই।’
এদিকে অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ব্যানারে কর্মসূচি পালন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেউ কর্মসূচি পালন করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত ১৭ জানুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়, যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিতে তোলপাড় চলছে। সেখানকার নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন, এই নিষেধাজ্ঞা কাদের বিরুদ্ধে? তারা বলছেন, এখানে দলীয় শৃঙ্খলা কিংবা নিয়ম ভঙ্গ করার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। শুধু চলমান কর্মসূচি দলীয় ব্যানারে পালন করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন খোকন ভুল বুঝিয়ে এই চিঠি ইস্যু করিয়েছেন। নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেট ও মহানগরের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে খোকন চরম স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতি করেছেন। নিজ বলয়ের লোকদের নিয়ে ৫ থেকে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন। নিউইয়র্ক স্টেট বিএনপির কমিটি গঠনের বিষয়ে খোকনের অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। খোকনের মদদেই যুক্তরাষ্ট্রে স্টেট ও মহানগর নামে পকেট কমিটি আছে। যা মূল ধারার বিএনপির নেতাকর্মীরা মানতে নারাজ।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সিনিয়র নেতা ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফোরাম যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন বলেন, ‘গত ১৫ বছর নিউইয়র্কে নেতা-কর্মীরা যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ব্যানারে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। শেখ হাসিনা পালানোর পরও একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন। কিন্তু বিশেষ একজন ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়ায় দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা বিএনপির হাইকমান্ড উপলব্ধি করতে পারছে না। সুতরাং দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি গঠন অত্যন্ত জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।’
মোতাহার হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কর্মীরা সব সময় ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলো। ফলে অনেকে নিজ ভূমিতে যেতে পারি নি। অথচ ২০১১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কমিটি নাই। তবে পকেট কমিটি আছে। সংখ্যায় খবুই কম। আমরা পকেট কমিটি চাই না। যুক্তরাষ্ট্রের সবাই আমরা এক ছাদের নিচে থাকতে চাই।’
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিএনপির অন্তত সিনিয়র নেতা জানান, চাকরি ও পেশাগত কাজের পাশাপাশি তারা নিঃস্বার্থভাবে বিএনপির রাজনীতি করছেন। বিগত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের বাধার মুখে পড়েও তারা থেমে থাকেননি। বিএনপিকে যুক্তরাষ্ট্রে সুসংগঠিত করেছেন। অথচ দলীয় পদবি না থাকায় এখন পরিবারের কাছেও এসব ত্যাগী নেতার সম্মান নেই। যুক্তরাষ্ট্রে দলীয় রাজনীতি ও কমিটির ব্যাপারে কেন্দ্রের উদাসীনতা, স্টেট কমিটির মাধ্যমে দলীয় রাজনীতি পরিচালনার সিদ্ধান্তে চরম হতাশা আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন প্রবাসের নেতা-কর্মীরা। তাই শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি দিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নেতা-কর্মীরা।
দলীয় সূত্রমতে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ভূমিকা ছিল নজিরবিহীন। শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফর ঘিরে তারা সংঘবদ্ধভাবে মানববন্ধন ও বিভিন্ন স্লোগান দেওয়ায় অনেকেই বাংলাদেশে মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত ১৫ বছর অনেকে দেশেও আসতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা মাযহারুল ইসলাম মিরন বলেন, ছাত্র জীবন থেকেই জিয়াউর রহমানের আদর্শ নিয়ে বড় হয়েছি। দলকে ভালোবাসার পরিণাম হিসেবে দেশ ছেড়েছি। অথচ আজকে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি নেই। মূলত আমাদের নেতা তারেক রহমান সাহেবকে ভুল বুঝিয়ে খোকন সাহেব কমিটি দিচ্ছেন না। এটা মূলত খোকনের কারণেই এটা হচ্ছে। আমরা দ্রুত সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি চাই। তবে এই বিষয়ে জানতে বার বার ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ দেয়া হলেও কোন উত্তর দেয়নি আনোয়ার হোসেন খোকন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম বলেন, গত প্রায় ১৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বিএনপির কমিটি নেই। নানা ঝামেলার কারণে দেয়া হয়নি। সর্বশেষ খোকনকে কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তিনি কমিটি গঠন করতে পারেননি। জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আপাতত স্টেট কমিটির প্রতি দল গুরুত্ব দিচ্ছে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি বিষয় দেখা হবে।