রাজধানী ঢাকায় একদিনে দুটি বড় ধরনের আন্দোলনের কারণে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে তীব্র যানজট দেখা দেয়, যার ফলে লাখ লাখ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। একদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবিতে লংমার্চ এবং অন্যদিকে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং শিক্ষার্থীদের ডিগ্রির স্বীকৃতি চেয়ে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান—এই দুই কর্মসূচি রাজধানীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করে তোলে। দিনভর উত্তেজনা, সংঘর্ষ, বিক্ষোভ এবং পুলিশি হস্তক্ষেপে দিনটি ঢাকা নগরবাসীর জন্য রীতিমতো বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে।
সকাল ১১টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যমুনা ভবনের উদ্দেশে ‘যমুনামুখী লংমার্চ’ শুরু করেন। মূলত ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন ভাতা চালু, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট অনুমোদন এবং দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণ প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদনের দাবিতে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রক্টর, বিভিন্ন অনুষদের ডিনসহ প্রশাসনের প্রতিনিধিরাও এই মিছিলে অংশ নেন। পথে পথে তারা পুলিশের বাধার মুখে পড়লেও মিছিল এগিয়ে যায় কাকরাইল মোড় পর্যন্ত। সেখানে পুলিশ টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এবং লাঠিচার্জ করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে।
সংঘর্ষের সময় শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। আহতদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো. রইছ উদ্দিন, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক বেলাল, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক নাসিরউদ্দিন এবং বিভিন্ন সাংবাদিক। প্রায় ৩৮ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হলেও পুনরায় সংগঠিত হয়ে কাকরাইল মসজিদের সামনে অবস্থান নেন এবং সড়কে বসে দাবি আদায়ের আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন।
তীব্র বৃষ্টির মধ্যেও আন্দোলন থেমে যায়নি। অবস্থানকারীরা পুলিশের ‘নির্মম হামলার’ বিচার দাবি করেন এবং বলেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সড়ক ছাড়বেন না। বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রেজাউল করিম, কোষাধ্যক্ষ ড. সাবিনা শারমিন ও ব্যবসায় অনুষদের ডিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন। সন্ধ্যার দিকে প্রধান উপদেষ্টার একান্ত সহকারী সচিব শাব্বির আহমদের সঙ্গে জবি প্রশাসনের একটি প্রতিনিধিদলের আলোচনা হয়। তবে রাতে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সড়ক ছাড়ার আহ্বান জানালে, শিক্ষার্থীরা তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন এবং বোতল ছুড়ে মারেন। তারা জানান, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চলবে।
এদিকে একইদিনে দুপুর ২টা থেকে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি—এই ডিপ্লোমা কোর্সকে ডিগ্রির সমতুল্য মর্যাদা দিতে হবে। এর আগে, তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেন এবং সেখান থেকে মিছিল নিয়ে শাহবাগে যান। পুলিশ তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তারা ব্যারিকেড অতিক্রম করে শাহবাগ মোড় দখল করে নেয়।
বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত তারা সড়কে বসে আন্দোলন চালিয়ে যান। ফলে শাহবাগসহ আজিমপুর, নিউমার্কেট, সায়েন্সল্যাব, ফার্মগেট, বাংলামোটর, রামনা, মৎস্য ভবনসহ রাজধানীর বিস্তৃত এলাকায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। অনেকে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছান। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, আগের সরকার ২০২১ সালে তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন করেনি। বর্তমান সরকারও ৭ এপ্রিল এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে প্রজ্ঞাপন জারির কথা বলেছিল, কিন্তু এখনো তা কার্যকর হয়নি।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সজীব ও সদস্য আকাশ মিয়া জানান, তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছেন এবং দাবির বিষয়ে সরকারকে পর্যাপ্ত সময়ও দিয়েছেন। কিন্তু সাড়া না পেয়ে বাধ্য হয়ে অবস্থানে বসেছেন। রাত ৯টার দিকে পুলিশ শাহবাগ এলাকা থেকে তাদের সরিয়ে দিলে যান চলাচল ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। এই দুই আন্দোলনের কারণে একদিনে রাজধানীজুড়ে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট ও চরম দুর্ভোগ। অফিসযাত্রী, রোগী, শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খেলেও সমালোচকরা বলছেন, সরকারঘনিষ্ঠদের কর্মসূচিতে সহনশীলতা এবং বিরোধীদের ক্ষেত্রে কঠোরতা প্রশাসনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এখনো কাকরাইল মোড়ে অবস্থান করছেন এবং তাদের দাবি পূরণ ও পুলিশের হামলার বিচার না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।