শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫ ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
 
শিরোনাম:


বাংলাদেশি শ্রমিক ও মহান মে দিবসের ইতিহাস এবং তাৎপর্য
মো. আফতাব আনোয়ার
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৫, ৭:২৭ PM আপডেট: ২৯.০৪.২০২৫ ৯:১৬ PM

শ্রমজীবী ভাইদের অমানুষিক পরিশ্রমে আমাদের অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে, অথচ তারাই আজ সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত। 
দেশের উন্নয়নে ও গণমানুষের অধিকার আদায়ে আমাদের বাংলাদেশি শ্রমজীবী ভাইয়েরা কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
লেখাপড়া না জানা মেহনতি মানুষরাই এ দেশের আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করে যাচ্ছেন। এরপরও শ্রমিক নেতাদের আন্তরিকতার অভাবে শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্যটা পাওয়ার জন্য রাজপথে  লড়াই করতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয় মহান মে দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। শুধুমাত্র মিছিল, শোভাযাত্রা ও জাতীয় ছুটি পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই কি শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা অর্জিত হবে? এজন্য প্রয়োজন সরকারিভাবে শ্রমিকদের প্রতি ইতিবাচক ও সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের মধ্য প্রায় ১২ কোটি ভোটার এবং বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শ্রমিক কর্মচারীর সংখ্যা ৭ কোটি ৩৫ লাখ। ৭ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিক-কর্মচারির মধ্যে নিবন্ধিত শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ৭০ লাখ এবং অনিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা ৬ কোটি ৬৫ লাখ। বিভিন্ন জটিলতার কারণে  শ্রমিক-কর্মচারি অনিবন্ধিত রয়ে যাচ্ছে। এই শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের নিবন্ধন অত্যন্ত জরুরি। সরকার, নিয়োগকর্তা এবং সকল শ্রমিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সচেতনতাই এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারে।
এদের জন্য সরকারি চাকুরিজীবীদের মতো সুনির্দিষ্ট বেতন কাঠামো তৈরি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করা অতীব জরুরি। যদিও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে এমন সুবিধা প্রদান করা মোটেও সম্ভব নয়, তবুও সরকারি উদ্যোগে যদি বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (২০০৬ সনের ৪২ নং আইন) এর  নিয়ম-নীতি প্রয়োজনে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে মেনে চলার শর্তে যদি  সকল প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক নিবন্ধনের মাধ্যমে একই ছাতার নীচে নিয়ে এসে যথাযথভাবে পরিচালনা ও মনিটরিং  করা হয় তাহলে অবশ্যই অনিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পাবে। এ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট শ্রমিক নেতাগণ যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সচেষ্ট হন, তাহলে শ্রমিকদের বহুবিধ সমস্যার সমাধান বহুলাংশে কমে আসবে বলে আমি মনে করি।
আমি অবাক হই এই ভেবে যে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের  বাঘা বাঘা সদস্যগণ শ্রমিক নেতা হওয়া সত্ত্বেও  কেনো শ্রমিকদের দাবি আদায়ে রাস্তায় নামতে হয়? তারা শ্রমিকদের জন্য কি করেছেন? শুধু নিজেদের নিয়েই তারা ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেছেন। তা-না হলে পয়লা মে আসে যায়, শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্যতা আদায়ে উদ্ভূত সমস্যাগুলো যেখানে ছিলো সেখানেই রয়ে যায়। শ্রমিকদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি করা মোটেই উচিত নয়। এখানে সবার পরিচয় হওয়া উচিত শুধুই শ্রমিক। এখানে কোনোক্রমেই শ্রমিক লীগ বা শ্রমিক দল হওয়া উচিত নয়। বর্তমান সরকারের সংস্কার কর্মসূচীতে এই বিষয়টি জরুরিভিত্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষরা যেনো উনিশ শতকের রক্তাক্ত ইতিহাসের মতো দাবি আদায়ের নামে রাস্তায় নেমে না আসেন সেদিকে সংশ্লিষ্ট সকলের সদয় দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক।

মহান মে দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য: 
১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন, এবং তাদের এ দাবি ১৮৮৬ সালের ১লা মে থেকে কার্যকর করার সময় বেঁধে দেন। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা আর সপ্তাহে ৬ দিন শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রম করতে হতো। বিনিময়ে পেতো খুবই কম মজুরী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে ক্রীতদাসের মতো আচরণও করতেন। এখান থেকেই শ্রমিকদের মাঝে সৃষ্টি হয় তীব্র অসন্তোষ। এই শ্রমিক অসন্তোষই পরবর্তীতে বৃহত্তর আন্দোলনের রূপ নেয়। ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিকদের দাবি আর সম্মিলিত আন্দোলন। কিন্তু কারখানা মালিকগণ এ দাবি মেনে না নেয়ায় ৪ঠা মে ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর ‘হে-মার্কেট’ নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রায় শ্রমিকদের উপস্থিতি, আগ্রহ, উদ্দীপনা দেখে এ মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিলো। আগস্ট স্পীজ নামে এক শ্রমিক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরন ঘটে, এতে এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়। পুলিশবাহিনী এ ঘটনায় শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করেন। যার ফলশ্র“তিতে ১১ জন শ্রমিক নিহত হন। এক প্রহসনমূলক বিচারে পুলিশ হত্যা মামলায় ‘আগস্ট স্পীজ’ সহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাগারে আত্মহত্যা করেন, অন্য একজনের পনের বছরের কারাদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার পূর্বে ‘আগস্ট স্পীজ’ বলেছিলেন, “আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে”। সত্যিই তাই হয়েছে। তাঁর এ কথার মাত্র এক বছর আট মাস তিনদিন পর ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পয়লা মে-কে বিশেষ দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেই থেকেই পয়লা মে পৃথিবীর অধিকাংশ  দেশে ‘মে দিবস’ বা ‘শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। সেখান থেকেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের সূচনা হয়। আর ১৮৯১ সালে প্যারিসেই দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। স্বীকৃতি পায় মে দিবস। তাছাড়া ইলিনয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হৃৎকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মধ্য-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত এই অঙ্গরাজ্যের গভর্ণর ২৬ জুন ১৮৯৩ সালে অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা করেন এবং শ্রমিকদের উপর অন্যায়ভাবে অতর্কিতে হামলার হুকুমদাতাকে অভিযুক্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের “দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি” অফিসিয়াল স্বীকৃতি পায়। শ্রমিকদের দাবি আদায়ের দিন হিসেবে পৃথিবীব্যাপী আজও তা ‘মে দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় ও পালিত হয়। শ্রমজীবী মানুষের এ যুগান্তকারী সফল আন্দোলনকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছরের ১লা মে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বাদে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে। 

জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শাখা হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই.এল.ও) প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার সমূহ স্বীকৃতি লাভ করে এবং সকল দেশে শিল্প মালিক ও শ্রমিকদের তা মেনে চলার আহবান জানায়। এভাবে শ্রমিক ও মালিকদের অধিকার সংরক্ষণ করে। বাংলাদেশ আই.এল.ও কর্তৃক প্রণীত নীতিমালার স্বাক্ষরকারী একটি দেশ।  ভারত ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পয়লা মে জাতীয় ছুটির দিন। বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে ‘মে’ দিবসটি বাংলাদেশ ও ভারতে পালিত হয়। আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়। হে মার্কেটের হত্যাকান্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন পয়লা ‘মে’-তে যে কোনো আয়োজন, হানাহানিতে পর্যবসিত হতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকেই আমেরিকা ও কানাডা প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার ‘লেবার ডে’ বা  শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশে এবারের মহান মে দিবস-২০২৫ এর প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এদেশ নতুন করে’। এই শ্লোগানটির যথার্থতা নিয়ে এগিয়ে যাক আগামীর শ্রমিক-মালিক, আগামীর বাংলাদেশ- এই প্রত্যাশায় রইল অনেক অনেক শুভকামনা। 

লেখক: কর্মকর্তা (অবঃ), বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি), পল্লী ভবন, কাওরান বাজার, ঢাকা। anwaraftab611@gmail.com







আরও খবর


প্রকাশক: এম এন এইচ বুলু
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মাহফুজুর রহমান রিমন  |   উপদেষ্টা সম্পাদক : রাজু আলীম  
বিএনএস সংবাদ প্রতিদিন লি. এর পক্ষে প্রকাশক এম এন এইচ বুলু কর্তৃক ৪০ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, বুলু ওশেন টাওয়ার, (১০তলা), বনানী, ঢাকা ১২১৩ থেকে প্রকাশিত ও শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
ফোন:০২৯৮২০০১৯-২০ ফ্যাক্স: ০২-৯৮২০০১৬ ই-মেইল: spnewsdesh@gmail.com