সেটা ১৯৭৪ সালের ঘটনা। তারিখটা সম্ভবত ২৮ জুলাই। একই দিনে মুন্সীগঞ্জের তিনটি থানা, ৪টি পুলিশ ফাঁড়িসহ সারা দেশে ২৬টি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি লুট হয়। নারায়ণগঞ্জের আদমজী পাটকলের একটি ইউনিটে আগুন লাগে, চট্টগ্রামে সরকারের মালিকানাধীন একটি পাটকলে আগুন লাগে, খুলনায় একটি পাটকল পুড়ে যায়, তৎকালীন রাজাবাড়ি মহকুমার খানখানাপুরে কৃষি ব্যাংকের একটি শাখায় ডাকাতি হয়। এটা আমার কথা নয়। তথ্যগুলো উল্লেখ করেছেন সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির একজন মাঠ পর্যায়ের নেতা তার লেখা ‘সর্বহারা পাটি ও রাজনীতি’ নামের বইয়ে।
চুয়াত্তর সালের সে দিনগুলোতে দেশে শত ভাগ আওয়ামী লীগ ছিলো। প্রকাশ্যে সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ। প্রশাসনের লোকেরাও আওয়ামী লীগ বনে গিয়েছিলো। সবার মুখে ছিলো বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা। তবে ভেতরের চিত্র ছিলো ভিন্ন। দিনে আওয়ামী লীগ- রাতে সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি এবং জাসদের গণবাহিনী এমন সংখ্যা নেহাত কম ছিলো না। বঙ্গবন্ধু øেহ করতেন আবদুল আউয়ালকে। এক সময়ে ছাত্রলীগ করতেন। তাকে আদমজী পাট কলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর পুরো আমলে নানা নাশকতা ঘটতে থাকে আদমজী পাটকলে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর জানা গেল আবদুল আউয়াল ছিলেন জাসদের লোক। সিরাজ শিকদারকে গ্রেপ্তারের জন্য বিশেষ স্কোয়াড করা হয়েছিলো। অথচ সেই সিরাজ শিকদার দিনের পর দিন বসবাস করেছেন রাজধানীর মগবাজারে। গোয়েন্দারা তাকে খুঁজে পায়নি। চুয়াত্তর সালের প্রথম দিকে বিশেষ স্কোয়াডের হাতে মাদারীপুর শহরে ধরা পড়েছিলেন সিরাজ শিকদার। ধরা পড়ার পর তাকে গ্রেপ্তার না দেখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাকে ছেড়ে দেন মেজর মহসিন। পরে জানা যায় মেজর মহসিন ছিলেন সর্বহারা পার্টির লোক, সিরাজ শিকদারের অনুসারী। সর্ব শেষ সিরাজ শিকদার যে মামলায় ফেরারি ছিলেন সে মামলাটি ছিলো সরকারের একটি গোয়েন্দা বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তার স্ত্রী লায়লাকে ভাগিয়ে নেওয়ার মামলা। সরকারি গোয়েন্দা বিভাগের ভেতরে নিজের লোক তৈরির জন্য সিরাজ শিকদার পদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তার স্ত্রীর সঙ্গে সখ্য তৈরি করেন। তাদেরকে কাজে লাগান, এক সময়ে লায়লার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হওয়ায় সিরাজ শিকদার তাকে ভাগিয়ে নেন, বিয়ে করেন। সেনা বাহিনীর মেজর জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিলো সিরাজ শিকদারের সঙ্গে। এই মেজর জিয়া পিরোজপুরের সুন্দরবনখ্যাত মেজর জিয়া নন, এই মেজর জিয়াউদ্দিনের বাড়ি চট্টগ্রামে। এক সময়ে পত্রিকায় কলাম লিখে সরকারের সমালোচনা করার দায়ে চাকরি যায় মেজর জিয়াউদ্দিনের। চাকরি যাওয়ার পর সিরাজ শিকদার তাকে সর্বহারা পার্টির সামরিক শাখার দায়িত্ব দেন। চাকরিচ্যুত হলে এই মেজর জিয়াউদ্দিন সিরাজ শিকদারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল ফারুক ও রশিদকে। ১৫ আগস্টের আগের দিন পর্যন্ত প্রতিদিন একবার বত্রিশ নম্বর বাড়িতে যাতায়াত করতো খুনি ডালিম। বেগম খালেদা জিয়া যেতেন প্রায় নিয়মিত। বত্রিশ নম্বর বাড়ি রেকি করার দায়িত্ব ছিলো তাদের। বঙ্গবন্ধু যাতে ভেতরের খুনিদের চিহ্নিত করতে না পারেন তার সব আয়োজন করা হয়েছিলো সফলভাবে। শত্র“-মিত্র চেনা যায়নি। কে কাকে সন্দেহ করবে সবাইতো আওয়ামী লীগ।
স্বাধীনতার পরবর্তীকালের সে দিনগুলোর সঙ্গে আজকের কোন মিল নেই। মিল পাওয়াও যাবে না। সেই সর্বহারা পাটিও নেই, গণবাহিনীও নেই। তবে মিল দেখা যায় এক জায়গায়- তখনো সবাই ছিলো আওয়ামী লীগ-এখনো হঠাৎ করে সবাই আওয়ামী লীগ। সন্দেহ করার মানুষ নেই। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কথা বললেই এমনটাই মনে হয়। প্রবাদ আছে ‘তোমারে বধিবে যে সে জন বাড়িছে গোকূলে’ পঁচাত্তরে কিন্তু তেমনটাই হয়েছিলো। খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনি হবে কেউ ভাবতেও পারেনি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা কোন ব্যক্তিকে হত্যা ছিলো না। হত্যা করা হয়েছিলো গোটা জাতির অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আমরা এর চেয়ে উন্নত বাংলাদেশ পেতাম আরো পঞ্চাশ বছর আগে। ইতিহাস বলে, যারা জিতে তারা ভুলে যায়, পরাজিতরা মনে রাখে। স্বাধীনতার শত্র“রা ভুলেনি, তাদের বংশধররা ভুলেনি। সুযোগ পেলে ছোবল তারা দেবেই। ওরা ঘাপটি মেরে আছে সবখানে। প্রশাসনে আছে, নানা বাহিনীতে আছে এখন ঢুকে পড়েছে স্বয়ং আওয়ামী লীগে। চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। বড় ভয়ের ব্যাপার এখানেই।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ২৫ জুন। পদ্মা সেতুর কথা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব মিডিয়ায়। পদ্মা সেতু মানে শেখ হাসিনার ইমেজ, তাঁর সরকারের উন্নয়ন। শত্র“দের বুক চিরে যাচ্ছে। সে কারণেই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে সোগান ওঠে পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।
দেশে নাশকতা হচ্ছে কি হচ্ছে না, সে বিষয়ে বলছি না। শুধু কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি। দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া কর্নেল শহীদ এতদিন বিদেশে বসে সরকারের কুৎসা রটিয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে খোদ ঢাকা শহরে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারপত্র বিলি করছে। সে প্রচারপত্র বিলি করার সময়ে তার লোক গ্রেপ্তারও হয়েছে। আলামতটা কি? সব সময়ে শত্র“দের টার্গেট থাকে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করা। তার জন্য এরা বেছে নেয় গুপ্তহত্যা নাশকতা। আগুন দেওয়া। ৮ জুন রাজধানীর হাতির ঝিলে সাংবাদিক বারীর ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গেল। ৫ জুন সীতাকুন্ডের ডিপোতে আগুন লাগলো। ৭ জুন চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন লাগলো। ৬ জুন হঠাৎ করে রাঙ্গামাটির সাংবাদিক মনজুর এলাহীকে গ্রেপ্তার করে সাংবাদিক সমাজকে অস্থির করে তোলা হলো। ২ জুন ঢাকায় সাংবাদিক নেতা ওমর ফারুকের ওপর হামলা করা হলো। ৮ জুন জয়পুর হাটের কালাই উপজেলায় মসজিদের ইমাম মহসীন আলীর জবাই করা লাশ পাওয়া গেল। সিলেটগামী ট্রেনের বগিতে আগুন লাগলো। আগুন লাগলো ফেরিতে। এরপর ঢাকার রাস্তায় একজন বরখাস্ত হওয়া সেনা কর্মকতার সরকার বিরোধী প্রচার পত্র বিলি। হয় তো এগুলো নাশকতা নয়, শুধুই ঘটনা। হয়তো আমরা সবাই ভাবছি এখন আর সেই চুয়াত্তর সাল এক নয়। হয়তো মনে করছি এখন সিরাজ শিকদারও নেই, গণবাহিনীও নেই। একবারও কিন্তু ভাবছি না সিরাজ শিকদারের চেয়েও ভয়ঙ্কর জামায়াত আছে, বিএনপিতে একাত্তরের পরাজিত শত্র“দের বংশধররা আছে। তবে একবার ভাবা উচিত, মনে রাখা উচিত- শেখ হাসিনা কিন্তু দেশটার শেষ সম্বল। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া এই সম্পদটা হেলায় হারালে শত শত যুগ কেন, শত শত বছরেও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো না আমরা।