বৈরী আবহাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পর্যটনের শহর কক্সবাজার। চলতি মৌসুমের রেকর্ড বৃষ্টিপাতে তলিয়ে গেছে শহরের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা। গত প্রায় তিন দশকে এই পরিমাণ জলাবদ্ধতা দেখেননি কক্সবাজারবাসী। এতে আটকা পড়েছেন প্রায় ২০ হাজার পর্যটক। চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন তারা।
টানা ভারী বর্ষণে পাহাড় ধস ও ট্রলারডুবিতে এই জেলায় আটজন নিহত হয়েছেন। সড়ক-উপসড়কে পানি উঠে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। শহরের হাজারও বসতবাড়ী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে লাখ লাখ টাকার মালামাল। এছাড়া কক্সবাজার সদরসহ আটটি উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে শতাধিক গ্রাম। এসব এলাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন লাখো মানুষ।
গত কয়েক দিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে কক্সবাজারে। গত বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টা থেকে শুক্রবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় মোট ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত।
অতিবৃষ্টিতে জেলা শহরের প্রায় ৮৫ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। শহরের প্রধান সড়ক, সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন সড়কসহ অন্তত ৪০টি উপসড়ক বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায়৷ সেই সাথে শহরের শতাধিক দোকানপাটের মালামাল নষ্ট হয়েছে। হাজারো ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জলাবদ্ধতার কারণে সৈকতে হোটেল মোটেল জোনের সব সড়ক ডুবে গেছে। কলাতলীতে অবস্থিত পাঁচ শতাধিক হোটেল মোটেলে অবস্থান নেওয়া অন্তত ২০ হাজার পর্যটক আটকা পড়েছেন।
এছাড়া উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড়ি ঢলের পানিতে বেশ কয়েকটি বসতি ডুবে যায়। জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, রামু, উখিয়া, টেকনাফ, ঈদগাঁও এবং কক্সবাজার সদরের নিম্নাঞ্চলে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়েছে বীজতলা, পানের বরজ এবং সবজি ক্ষেত। ইতোমধ্যে আট উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাঁকখালি এবং মাতামুহরী নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নতুন করে শত শত এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টা থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হলেও ভারী বর্ষণ শুরু হয় দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে। এরপর রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত টানা ১২ ঘণ্টার ভারী বর্ষণ মানুষের কর্মজীবন অনেকটাই থামিয়ে দেয়।
সাংবাদিক ফরিদুল আলম শাহীন বলেন, কক্সবাজার শহরে এমন জলাবদ্ধতা গত ৩০ বছরেও চোখে পড়েনি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পৌরসভার মেয়রসহ অধিকাংশ কাউন্সিলর আত্মগোপনে চলে যান। শহরের ময়লা-আবর্জনায় নালা-নর্দমা ভরে আছে। ভারী বর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানি নালা দিয়ে নেমে যেতে পারছে না বলেই শহরজুড়ে এমন জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সড়কের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
এদিকে, ভারী বর্ষণের কারণে জেলার অধিকাংশ পাহাড়ে ফাটল দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু এলাকায় ভূমিধসের ঘটনাও ঘটছে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে সদরের ঝিলংজা দক্ষিণ ডিককুল এলাকায় পাহাড় ধসে স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমানের পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন মিজানের স্ত্রী আঁখি মণি (২৮), মেয়ে মিহা জান্নাত (১২) ও লতিফা ইসলাম (৯)। পাহাড়ের পাদদেশে মিজানের বাড়ি অবস্থিত হওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার বিকেলে শহরের হালিমারঘোনায় পাহাড় ধসে জাহেদ হোসেন (৭) নামের এক শিশু নিহত হয়েছে। অন্যদিকে, উখিয়া ১৪ নম্বর হাকিমপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে তিনটি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে একই পরিবারের তিনজন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন, ১৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ই-২ ব্লকের কবির আহমেদের ছেলে আব্দুর রহিম, আব্দুল হাফেজ এবং আব্দুল ওয়াহেদ।
শুক্রবার বিকেলে বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার লাবণী এলাকায় ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে ২৩ জেলে নিয়ে ‘এফবি রশিদা’ নামে একটি ফিশিং ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটেছে । এ ঘটনায় গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার মোহাম্মদ জামাল (৩৭) নামে এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। ট্রলারটির আরও চার মাঝিমাল্লা নিখোঁজ রয়েছেন। কক্সবাজার ত্রাণ ও প্রত্যাবাশন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ দৌজা নয়ন জানিয়েছেন, ভারী বর্ষণে উখিয়া ১৪ নম্বর হাকিম পাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে তিনটি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকেরা বিধ্বস্ত ঘর বাড়িতে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কক্সবাজার আবহাওয়া কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ আব্দুল হান্নান বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টা থেকে শুক্রবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত কক্সবাজারে ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে এটি এক দিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টির রেকর্ড। আরও কয়েক দিন ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানান তিনি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাশ গণমাধ্যমকে বলেন, শুক্রবার সকালে ঝিলংজায় ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত তিনজনের পরিবারকে ৭৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান থেকে লোকজনকে সরিয়ে আনা হচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে চারটি পৃথক টিম মাঠে নেমেছে৷