ভয়ংকর টাইফুনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জাপান ভ্রমণের সীমা কিছুটা সংকুচিত করে চার দিন আগেই প্যারিসের উদ্দেশে রওনা দিতে হলো। সেখানে মানুষের মধ্যকার টাইফুন আতঙ্ক আমার পরিবারের মধ্যেও প্রভাব ফেলেছে। আমার কিন্তু প্রবল ইচ্ছা ছিল কিওটো আর ওসাকা ভ্রমণের সময় ঐতিহাসিক হিরোশিমা শহরটা আবারও দেখে আসার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন পারমাণবিক বোমার প্রথম ব্যবহারের স্মৃতিময় শহরটার প্রতি আমার সব সময়ই একটা আকর্ষণ আছে। যেহেতু জাপানে সমস্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ, তার পরও টোকিওর প্রধান স্টেশনে গিয়ে নিশ্চিত হলাম যে কিওটোর নির্ধারিত দ্রতগামী ট্রেন ‘সেংকিনসেন' তিন দিনের জন্য বন্ধ। আর বিলম্ব নয়, জাপান এয়ারলাইনসের অফিসে গিয়ে সরাসরি ফ্লাইট, যাতে ১৫ ঘণ্টায় প্যারিসে পৌঁছে যাওয়া যায় তার সিট কনফার্ম করলাম । যত তাড়াতাড়ি প্যারিসে ফেরা যায়, ততই যেন রক্ষা। এ ক্ষেত্রে আমার আর সন্তানদের চেয়ে তাদের মায়ের মধ্যেই ভয়ভীতি কাজ করেছে বেশি। অবশ্য টাইফুন জাপানে নতুন কিছু না হলেও এরপর দেশটিতে যেন আর কেউ বেঁচে থাকবে না – আমাদের মাঝে এমনই একটা ভাব।
যা হোক, ফিরে আসার আগের বিকেলে আমাদের ঘনিষ্ঠ লিয়াকত ভাই, নান্নু ভাইয়ের পরিবার এবং অন্যদের সমন্বয়ে চমৎকার একটা বারবিকিউ পার্টি দিয়েছিলেন। দারুণ একটা সময় কাটিয়েছি! ওনাদের আন্তরিকতা হৃদয়ে গেঁথে থাকবে ।
ব্রেকফাস্ট সেরে আমি চেকআউট করার জন্য হোটেলের কাউন্টারে গেলাম, আর সবাই পূর্বনির্ধারিত ট্যাক্সির অপেক্ষায় লাগেজগুলো নিয়ে বাইরে গেল । আমি যখন ট্যাক্সির কাছে পৌঁছলাম, তখন সমস্ত লাগেজ গাড়িতে ওঠানো প্রায় শেষ। লক্ষ করলাম, একহারা গড়নের জাপানি এক তরুণী ২০ কেজি ওজনের শেষ বাক্সটি গাড়িতে উঠিয়ে পেছনের দরজা বন্ধ করে দিল। হোটেলের পোর্টার ভেবে তাকে ৫০ ইউরো টিপস দিতে গেলে সে তা প্রত্যাখ্যান করল। ভুলেই গিয়েছিলাম যে জাপানে টিপস চর্চা নেই। তারা মাসের বেতনটাকেই তাদের প্রকৃত উপার্জন বলে মনে করে ।
আমি গাড়িতে বসার পর মেয়েটা ছোট্ট একটা হাসি উপহার দিয়ে আমার দরজা বন্ধ করে দিল । ভীষণ অবাক হলাম সেই একই মেয়ে যখন ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এবার এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা হলো। তখন আর বুঝতে বাকি রইল না যে আসলে মেয়েটি হোটেল কর্মচারী নয়, আমাদের নিতে আসা গাড়ির ড্রাইভার। পাশের সিটে বসে লক্ষ করলাম, চমৎকার পরিপাটি করে চুল বাঁধা, সাদা শার্ট, কালো ট্রাউজার, হাতে সাদা গ্লাভস, মসৃণ অবয়ব সংবলিত মেয়েটির চেহারায় একটা বিশেষ মাধুর্য আছে। সোজা রাস্তার দিকে নজর রেখে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার মধ্যেও ফাঁকে ফাঁকে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি, সেই সঙ্গে সামান্য কথাবার্তায় তাকে আরও আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল ।
এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পর সবাই লাগেজ নিয়ে হাঁটা শুরু করলেও আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হ্যান্ডশেক করে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়ালাম । তার চোখে চোখ রেখে ভাবলাম, কত কাছের কাউকে ছেড়ে যাচ্ছি! আর কোনো দিন হয়তো তার সাথে দেখা হবে না। এই অনুভূতি হয়তো এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের অনেকের মাঝেই এসেছে, কিন্তু কেউ তা প্রকাশ করার ইচ্ছা করেনি। এ ব্যাপারে উপযুক্ত সময় বা সাহস অনেকেরই থাকে না।
দূর থেকে লক্ষ করলাম, মেয়েটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে। এরপর খানিকটা হাত নেড়ে তার ট্যাক্সিতে উঠে গেল । আমিও তার হাত নাড়ার উত্তরে নিজের হাতটা নেড়ে তাকে বিদায় জানালাম। অনুভব করলাম, হৃদয়ের গভীরের কোনো একটা অংশের একটা বিশেষ অনুভূতি এ শহরে রেখে গেলাম ।
টোকিও, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
লেখক : প্রবাসি লেখক কাজী এনায়েত উল্লাহর জন্ম ১৯৫৮ সালের ৮ই নভেম্বর। ঢাকার বনানী চেয়ারম্যান বাড়ীর সন্তান ১৯৭৮ সাল থেকে ফ্রান্সে বসবাস করছেন। প্যারিসের সর্বোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষা লাভ করার পর, নিজেকে ব্যাবসায় আত্বনিয়োগ করেন। এবং যথাক্রমে রেস্টুরেন্ট, রিয়াল স্টেট, ট্রাভেল ব্যাবসা সহ পারফিউম ব্যাবসায় নিয়োজিত আছেন। ব্যবসায়িক সাফল্যের সংগে ফ্রান্সে না না সামাজীক কর্ম কান্ডে জড়িত কাজী এনায়েত উল্লাহ ইউরোপের ২৫টি দেশের প্রবাসী বাংলাদেশিদের শীর্ষ সংগঠন অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন (আয়েবা) মহাসচিব ও ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউবিও) সভাপতি।
২০১৬ সালে নভেম্বর মাসে ওনার উদ্যোগে সংগঠিত হয় মালয়েশীয়ার কুয়ালালুমপুরে ফার্স্ট বাংলাদেশ গ্লোবাল সামিট।বিশ্ব প্রবাসি ৬০০ বাংলাদেশী এই মহাসম্মেলনে যোগদান করেন।এবং সংগঠিত হয় ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন। কাজী এনায়েত উল্লাহ নির্বাচিত হন সংগঠনের প্রথম প্রতিস্ঠাতা প্রসিডন্ট।বিশ্বব্যপি প্রবাসিদের মধ্যে সংযোগের মাধ্যমে এক শক্তিশালী কমিউনিটি গঠনের লক্ষে তিনি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিন আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া সহ এশিয়ার সমস্ত বাংলাদেশী অধ্যুসিত বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।