যখন কোনো ওয়েবসাইট বা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট লগইন করবেন তখন দেখবেন স্ক্রিনে একটি ‘পপআপ’ ভেসে উঠেছে। সেখানে আপনাকে পাসওয়ার্ড ‘সেভ’ করে রাখার অপশন দেবে। আপনি চাইলে তাতে সম্মতি দিতে পারেন, আবার নাও দিতে পারেন। এখন মনে হতেই পারে সেটি কী? যত বারই কোনও নতুন সাইটে গিয়ে নিজের অ্যাকাউন্ট খুলছেন, তত বারই সেই চিরকুট ভেসে উঠছে স্ক্রিনে। আরও একটি ব্যাপার খেয়াল করেছেন? গুগল ক্রোমে গিয়ে ডান দিকের উপরে থ্রি ডটে ক্লিক করুন। এ বার স্ক্রল করে নিচে নামার সময়ে দেখবেন একটি নীল-লাল-হলদ-সবুজ রঙের চাবির ছবি রয়েছে। এই চাবিই হল সেই মোক্ষম অস্ত্র, যা অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করছে। এরই নাম হল ‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’, যা নিয়ে এখন বিশ্বজুড়ে হইচই চলছে।
‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’ কী, কোন কাজে লাগে, কেন লোকমুখে এর নাম এত ছড়াচ্ছে— তা জানতে হলে কয়েকটি ব্যাপার জেনে নেওয়া জরুরি। খেয়াল করে দেখুন তো, ডিজিটাল প্রযুক্তি যত এগোচ্ছে, তত খাটাখাটনির বহর কমে যাচ্ছে। আগে ফোন নম্বর মনে রাখতে তা ডায়েরির পাতায় লিখে রাখতে হত। প্রায় সব বাড়িতেই ছিল সেই ফোন নম্বর লেখার ডায়রি। তাতেই বিভিন্ন পরিচতজনের নম্বর লেখা থাকত। ঘেঁষাঘেঁষি, গাদাগাদি করে লিখে রাখা নম্বর অনেক সময়ে খুঁজেও পাওয়া যেত না। স্মার্টফোন আসার পর সেই পরিশ্রমে ইতি পড়ে। কারণ, ফোন তার স্মৃতিতেই ধরে রাখে সব কিছু। মানুষের স্মৃতি আর কাজে লাগানোর দরকার পড়ে না।
ঠিক তেমনই, ইন্টারনেট প্রযুক্তিতেও। এখন হাজারটা অনলাইন সাইট, বিভিন্ন রকম অ্যাপ, ই-কমার্স সাইট। এত দিন কেবল গুগ্লের পাতাতেই আনাগোনা ছিল যাঁদের, তাঁরা এখন অনলাইনে কেনাকাটা, খাবার অর্ডার, ব্যাঙ্কিং, এমনকি, বাড়ির টিভি-বিদ্যুতের বিল জমা দেওয়া থেকে শুরু করে টাকাপয়সার লেদনেন-ব্যবসা— কী না করছেন! আর যতই নিত্য নতুন অ্যাকাউন্ট খুলছেন, ততই পাসওয়ার্ডের সংখ্যা বাড়ছে। এখন কোন সাইটে লগইনের জন্য কী পাসওয়ার্ড দিয়েছিলেন, তা মনে রাখা খুবই ঝক্কির কাজ। সেই কাজটিই সহজে করে দিচ্ছে ‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’। এর কাজ হল মনে রাখা। আপনি যা পারছেন না, আপনার হয়ে সে তা করে দিচ্ছে। আপনাকে শুধু পাসওয়ার্ড মনে রাখার সম্মতিটুকু দিতে হবে।
ঠিক যেন চাবির গোছা
‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’ হল এক ধরনের সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন, যার কাজ অনেক। আসল কাজ হল মনে রাখা। অনলাইনের কোন অ্যাকাউন্টে আপনি কী পাসওয়ার্ড দিয়েছিলেন, তা আপনি ভুলে গেলেও এই সফটওয়্যার ভুলবে না। ফের যখন সেই সাইটে লগইন করবেন, তখন আর আপনাকে পাসওয়ার্ড মনে করে টাইপ করতে হবে না। এই সফটওয়্যারই সেই কাজ করে দেবে। ভেবে দেখুন, অনেকটা চাবির গোছার মতো। এটি এমনই শক্ত বাঁধন যাতে একটি চাবিও না হারিয়ে যায়। ‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’ হল সেই চাবির গোছাখানি। আপনার যদি অনলাইনে একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকে, তা হলে সব কয়টির পাসওয়ার্ড শক্ত করে বেঁধে রাখবে ‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’। সেখান থেকে হারিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই। আপনাকে কষ্ট করে মনে রাখতে হবে না।
স্ট্রং পাসওয়ার্ড
পাসওয়ার্ডে থাকতে হবে অক্ষর, যতিচিহ্ন, সংখ্যা সবই। অক্ষর বড় হাতের (ক্যাপিটাল) ও ছোট হাতের (স্মল) মিলিয়ে করতে হবে। পাসওয়ার্ড এমন হতে হবে, যা চট করে হ্যাকারদের কবলে যেতে পারবে না। তেমন পাসওয়ার্ড অনেকেই তৈরি করতে পারেন না। কিন্তু পাসওয়ার্ড ম্যানেজার তা করে দেবে আপনার হয়ে। ধরা যাক, কোনও অনলাইন ই-কমার্স সাইটে আপনি অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। সেখানে কেনাকাটা করবেন, তার মানে অনলাইনে টাকাপয়সার লেনদেনও হবে। কাজেই আপনার অ্যাকাউন্টটি সুরক্ষিত রাখা জরুরি। সে জন্য অ্যাকাউন্টে লগইন করা সময়ে সেই অনলাইন সাইট বা অ্যাপের পক্ষ থেকেই আপনার কাছে ‘স্ট্রং পাসওয়ার্ড’ চাওয়া হবে। আপনি না পারলে সেটি আপনার হয়ে করে দেবে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার। যত অ্যাকাউন্টই থাকুক না কেন আপনার, প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা ‘স্ট্রং পাসওয়ার্ড’ বেছে নেবে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার। আপনাকে আর সেগুলি মনে রাখতে হবে না। এখানেই এই সফটওয়্যারের সুবিধা।
কীভাবে কাজ করবে?
আপনার কাজ হল পাসওয়ার্ড ম্যানেজারকে সুরক্ষিত রাখা। পাসওয়ার্ড ম্যানেজারে ঢোকার জন্য একটি শক্তিশালী পাসওয়ার্ড (মাস্টার পাসওয়ার্ড) বেছে নিতে হবে এবং কেবল সেটিই মনে রাখতে হবে। সহজে মনে রাখার জন্য অনেকে তাদের একাধিক অ্যাকাউন্টে একই পাসওয়ার্ড দিয়ে দেন। এটি নিরাপদ নয়। কারণ একটি পাসওয়ার্ড চুরি গেলে সব অ্যাকাউন্টের ব্যক্তিগত ও গোপন তথ্য হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই প্রতিটি অ্যাকাউন্টের জন্যই আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ড দেওয়া জরুরি। আর সেগুলো মনে রাখার জন্যই পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের ব্যবহার করা যেতে পারে। ওয়েব সার্ভার থেকে পাসওয়ার্ড ম্যানেজারকে কাজে লাগানো যাবে, আবার গুগল প্লে স্টোরেও অনেক অ্যাপ চলে এসেছে। কতগুলির আবার লাইসেন্স আছে যা আপনাকে টাকা দিয়ে সাবস্ক্রাইব করতে হবে।
নিরাপদ তো?
‘ওয়ান পাসওয়ার্ড’, ‘লাস্টপাস’, ‘কিপাস’, ‘এনপাস’, ‘বিটওয়ার্ডেন’, ‘ড্যাশলেন’, ‘পাসওয়ার্ড বস’ এমন অনেক পাসওয়ার্ড ম্যানেজার রয়েছে, যা গ্রাহকদের পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত রাখে। অনলাইনে কিছু সেভ করে রাখা মানেই সেখানে ঝুঁকি থেকে যায়। কিন্তু ভালো পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের তিন স্তরীয় সুরক্ষা থাকে। যে সংস্থা সেই সফটওয়্যার তৈরি করেছে, তারা গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করে রাখলেও তা তৃতীয় ব্যক্তির হাতে যেতে দেয় না। কারণ, এর সঙ্গে ‘টু-ফ্যাক্টর-অথেনটিকেশন’ জুড়ে রয়েছে। তাছাড়া, পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের জন্যও আপনি আবার ‘মাস্টার পাসওয়ার্ড’ দিয়ে রাখছেন, যা কেবল আপনিই খুলতে পারবেন। কেবল আপনার আর সফট্ওয়্যারের মধ্যেই সেই গোপনীয়তাটুকু বজায় থাকবে। আর যেহেতু ‘ডেটা এনক্রিপ্ট’ করা থাকবে, তাই হাতছাড়া হওয়ার ভয় কম। আপনার ব্যক্তিগত তথ্যে নজর দিতে হলে হ্যাকারদের সেই তিন স্তরের নিরাপত্তা ভাঙতে হবে যা সহজসাধ্য নয়। সব ধরনের ব্রাউজার ও অপারেটিং সিস্টেমে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করতে পারেন। কেউ আপনার অ্যাকাউন্টে ঢোকার চেষ্টা করলে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার সতর্ক করবে। তখন সেই অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডটি বদলে ফেলতে পারবেন।