সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশে তৈরি হওয়া উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সংকটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) প্রতিষ্ঠানগুলো। টানা কয়েক দিনের সহিংস পরিস্থিতি, ইন্টারনেট বন্ধ থাকা ও করফিউর মধ্যে বেশির ভাগ এসএমই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন, বেচাকেনা ও বিপণন কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। এ সময় কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়া নিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠান সংকটে পড়েছে। ইন্টারনেট পুরোপুরি সচল না থাকায় ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে এসএমই উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার আহ্বান জানিয়েছেন।
রাজধানীর আজিমপুরে অবস্থিত একটি এসএমই প্রতিষ্ঠান হাতবাক্স। প্রতিষ্ঠানটি দর্শনীয় বিভিন্ন স্থাপনার রেপ্লিকা বা ছোট্ট প্রতিরূপ তৈরি করে। গত বছরের জুলাই মাসে পণ্য বিক্রি করে ৪৮ লাখ টাকার বেশি আয় করেছিল তারা। কিন্তু জুলাই মাসে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি আয় করেছে সাড়ে ৭ লাখ টাকার মতো।
এ বিষয়ে হাতবাক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাফাত কাদির বলেন, স্বাভাবিক সময়ের মাত্র এক ঘণ্টার বিক্রিও এখন ১০ দিনে হচ্ছে না। সামনের মাসে কীভাবে কর্মীদের বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করব, সেই চিন্তায় আছি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাতে নতুন কোনো কার্যাদেশ পায়নি হাতবাক্স; বরং এ সময় টানা সাত দিন তাদের পণ্য উৎপাদন বন্ধ ছিল। অনলাইনে ও বিক্রয়কেন্দ্রেও সেভাবে পণ্য বিক্রি হয়নি। সব মিলিয়ে তাদের আয় কমেছে কয়েক গুণ।
হাতবাক্সের মতো কমবেশি একই চিত্র–তথ্য জানা গেছে আরো অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক পর্যায়ে দেশজুড়ে সহিংসতা শুরু হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই মধ্যরাত থেকে সারা দেশে কারফিউ বা সান্ধ্য আইন জারি করে সরকার। এছাড়া ২১ থেকে ২৩ জুলাই, এই তিন দিন সাধারণ ছুটি থাকায় দেশের সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকে।
এসএমই উদ্যোক্তারা জানান, করোনা মহামারির পরে গত চার-পাঁচ বছরে বেশ কিছু সংকটের মধ্য দিয়ে গেছেন তারা। বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের চড়া সুদহার ও মার্কিন ডলারের বাড়তি দামের কারণে তারা চাপের মধ্যে রয়েছেন। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুসহ পরিষেবার খরচ বেড়েছে। এমন বাস্তবতায় সাম্প্রতিক ও চলমান পরিস্থিতি তাদের সংকটকে আরো বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘উৎপাদন শিল্প জরিপ ২০১৯’ অনুসারে, দেশে এসএমই শিল্পকারখানার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার।
আর ২০১৩ সালে বিবিএসের করা অর্থনৈতিক শুমারির তথ্য বলছে, দেশে শিল্পকারখানা ও ট্রেডিং মিলিয়ে সিএমএসএমই খাতে উদ্যোক্তা রয়েছেন ৭৮ লাখের বেশি।
এসএমই খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, টানা কয়েক দিনের সহিংস পরিস্থিতি, ইন্টারনেট বন্ধ থাকা ও করফিউর মধ্যে বেশির ভাগ এসএমই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন, বেচাকেনা ও বিপণন কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। এ সময় কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়া নিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠান সংকটে পড়েছে।
কারখানায় কুলিং টাওয়ারসহ বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি করে আর্টিজান ক্র্যাফট (বিডি)। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহেদ হাসান জানান, গত সপ্তাহে তাদের পণ্য বিক্রির বিপরীতে ৩০ লাখ টাকা (পেমেন্ট) আসার কথা ছিল। কিন্তু এখনো সে পেমেন্ট তারা পাননি।
অন্যদিকে আমদানি করা কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি বন্দর থেকে ছাড়িয়ে আনার ক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়েছেন অনেকে। টঙ্গীতে অবস্থিত প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠান কিউ পেইল লিমিটেড এমনই একটি প্রতিষ্ঠান। কিউ পেইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসির জানান, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বন্দরে তাদের চার–পাঁচটি পণ্যের চালান আটকে আছে। সেগুলো না আসায় কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
সরকার ১৭ জুলাই বুধবার রাতে দ্রুতগতির ফোর-জি নেটওয়ার্ক এবং পরদিন বৃহস্পতিবার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়। টানা পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর দেশে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু করা হয়। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও টিকটক বন্ধ রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে অনলাইনভিত্তিক এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম কার্যত বন্ধ হয়ে আছে, যার প্রভাব পড়েছে তাদের পণ্য বেচাকেনায়। একই সঙ্গে অনলাইনে অর্ডার করা পণ্য সরবরাহে যুক্ত ব্যক্তিদেরও (ডেলিভারি পারসন) আয়রোজগার নেই।
দেশের অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠানই অনলাইনে (ফেসবুক বা অন্য ওয়েবসাইট) তাদের ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা করে। খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে ই-কমার্স ও এফ-কমার্স (ফেসবুকভিত্তিক) প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ লাখ। এসব প্রতিষ্ঠান দৈনিক সব মিলিয়ে ৭ লাখের বেশি পণ্য ডেলিভারি করে থাকে।
অনলাইনে পোশাক বিক্রি করে গয়না বাক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি ঢাকায় আছে তিনটি বিক্রয়কেন্দ্র। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রাহক অনলাইনে পণ্যের লাইভ বর্ণনা দেখে বিক্রয়কেন্দ্র থেকে পণ্য কেনেন কিংবা সরাসরি অনলাইনে অর্ডার দেন। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ ধরে এসব কার্যক্রম বন্ধ। গয়না বাক্সের স্বত্বাধিকারী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ইন্টারনেট ও ফেসবুক বন্ধের কারণে এখন আমাদের ব্যবসাও কার্যত বন্ধ রয়েছে।
চলমান পরিস্থিতি কাটিয়ে ব্যবসায়ের স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন এসএমই উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ইন্টারনেট খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে তারা বলছেন, এসএমই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) প্রভাব ফেলবে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন মো. মাসুদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে আমরা একটি কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আন্দোলন ঘিরে কয়েক দিনের উত্তাল পরিবেশ; তারপর কারফিউ এবং ইন্টারনেট পুরোপুরি সচল না থাকায় ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে আশা করছি, সপ্তাহখানেকের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।