প্রকাশ: রবিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৩, ৯:৫৩ PM আপডেট: ১৯.১১.২০২৩ ৯:৫৯ PM
লক্ষ্য খুব বড় নয়, ২৪১ রানের। তবে ছোট লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুতেই বিপদে পড়েছিল অস্ট্রে লিয়া। মোহাম্মদ শামি-জাসপ্রিত বুমরাহদের বোলিং তোপে ৪৭ রান তুলতেই তারা হারিয়ে বসে ৩ উইকেট। তবে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে অসিরা। ট্রাভিস হেড আর মার্নাস লাবুশেনের অবিচ্ছিন্ন শতরানের জুটিতে বিশ্বকাপের ষষ্ঠ শিরোপার পায় অস্ট্রেলিয়া। আজ আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে স্বাগতিক দল ভারতকে ৬ উইকেটে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। ‘মনে হচ্ছে বিশ্বকাপ ফাইনাল হচ্ছে ফাঁকা মাঠে। ভারতের দর্শকদের জন্য লজ্জা’-ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার নাসের হুসেন কিছুক্ষণ আগেই স্কাই স্পোর্টসে এমনটা বলেছেন। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ, তার ওপর ফাইনালে লড়ছে স্বাগতিক দল। দীর্ঘদিন পর আরেকটি শিরোপা জয় দেখার প্রার্থনায় গোটা ভারত। যার একটি অংশ আজ আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে হাজির হয়ে ছিলেন। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই ভেন্যুর ধারণক্ষমতার হিসাবে দেখা হলে— সংখ্যাটা হতে পারে এক লাখ ৩০ হাজার। তবে বাস্তবে নিশ্চিতভাবেই সংখ্যাটা আরও বেশি হবে। নীল সমুদ্রে যেন ভাসছিল আহমেদাবাদ। তবে এই সমুদ্রসম দর্শকদের নিস্তব্ধ করার কথা আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। দারুণ পারফরম্যান্সে মাঠে ঠিকই দর্শকদের চুপ করিয়ে দিলেন। পুরো রোমাঞ্চ ছুয়ে গেল পুরো ইনিংসজুড়ে। রোহিত শর্মা যেমন করেছেন বিশ্বকাপজুড়ে, এদিনও করলেন তেমনই; থাকলো কেবল ইনিংস বড় না করার আফসোস। এর আগে ভারতের ছুড়ে দেওয়া ২৪১ রানের লক্ষ্য তাড়ায় নেমে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই ওপেনার ওয়ার্নারের উইকেট হারায় পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। ৩ বলে ৭ রান করে ওয়ার্নার ভারতীয় পেসার মোহাম্মদ শামির বলে বিরাট কোহলির হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন। এরপর মিচেল মার্শ ভালো শুরুর ইঙ্গিত দিলেও ফিরেছেন দ্রুতই। ১৫ বলে তার ১৫ রানের ইনিংস থামে জাসপ্রিত বুমরাহর বলে উইকেটকিপার লোকেশ রাহুলের হাতে ক্যাচ তুলে দিলে। এরপর বুমরাহর বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন স্মিথ (৪)। যদিও রিভিও নিলে বেঁচে যেতেন তিনি। রিপ্লেতে দেখা গেছে, বল অফ স্ট্যাম্প মিস করতো। স্মিথের আউটের পেছনে পরোক্ষ অবদান রাখা হেড অবশ্য পরে ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছেন। ধীরে ধীরে সেট হয়ে তুলে নিয়েছেন দারুণ এক ফিফটি। সেই সঙ্গে লাবুশেনের সঙ্গে বড় জুটি গড়ে দলকে রাখেন লড়াইয়ে। কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ অস্ট্রেলিয়ার হাতে তুলে দেন হেড ও লাবুশেন। এরপর ধীরে ধীরে হাত খুলতে শুরু করেন হেড।
৯৫ বলে তুলে নেন দারুণ এক সেঞ্চুরি। অথচ এ আসরের প্রথম ৫ ম্যাচে মাঠেই নামতে পারেননি তিনি। কিন্তু পরের ৬ ম্যাচে হাঁকিয়ে ফেললেন দুই সেঞ্চুরি। বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে মাত্র সপ্তম ব্যাটার হিসেবে সেঞ্চুরির দেখা পেলেন হেড। এর আগে এই কীর্তিতে নাম লিখিয়েছেন ক্লাইভ লয়েড (১৯৭৫), ভিভ রিচার্ডস (১৯৭৯), অরবিন্দ ডি সিলভা (১৯৯৬), রিকি পন্টিং (২০০৩), অ্যাডাম গিলক্রিস্ট (২০০৭) এবং মাহেলা জয়াবর্ধনে (২০১১)। তবে লঙ্কান গ্রেট ডি সিলভার পর মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে ফাইনালে লক্ষ্য তাড়ায় নেমে সেঞ্চুরির দেখা পেলেন হেড। এর আগে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে বিরাট কোহলির ৫৪, লোকেশ রাহুলের ৬৬ ও রোহিত শর্মার ৪৭ রানের ইনিংসে ভর করে ১০ উইকেট হারিয়ে ২৪০ রানের মাঝারি সংগ্রহ দাঁড় করায় ভারত। সাত ওভারের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ৩ উইকেট নেই। স্কোরবোর্ডে রান উঠেছে ৪৭। ভারতের দেওয়া ২৪১ রানের লক্ষ্য তখন পাহাড়সমই ঠেকার কথা অস্ট্রেলিয়ার কাছে। তবে অস্ট্রেলিয়াকে পথ হারাতে দেননি ট্রাভিস হেড।সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মহাগুরুত্বপূর্ণ ইনিংসের পর আজ ফাইনালেও দাঁড়িয়ে গেছেন তিনি। দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিতে সব আলো কেড়ে নিয়েছেন নিজের দিকে। ১০৭ রানে অপরাজিত আছেন তিনি। বড় মঞ্চ আর প্রতিপক্ষ ভারত হলেই হেড যেন অন্য রূপ ধারণ করেন। গত জুনে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। প্রথম ইনিংসে ম্যাচজয়ী এক ইনিংস খেলেছিলেন। আজ ভারতকে পেয়ে আরেকবার সেই রূপ ধারণ করেছেন হেড। তাঁর সঙ্গে চতুর্থ উইকেট জুটিতে ব্যাটিং করছেন মারনাশ লাবুশেন। ৮৪ বলে ৪১ রানে অপরাজিত আছেন তিনি। দুজনের জুটি থেকে উঠেছে ১৪৫ রান। ৩ উইকেট হারিয়ে ৩৫ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ১৯২ রান। বিশ্বকাপ জয় থেকে আর ৪৯ রান দূরে আছে তারা। সময় যত এগোচ্ছে, ভারতের শিরোপা জয়ের স্বপ্ন তত মলিন হচ্ছে। ম্যাচে ফিরতে হলে দ্রুতই এই জুটি ভাঙতে হবে তাদের। অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের তোপ সামলে দারুণভাবেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল বিরাট কোহলি-লোকেশ রাহুল জুটি। কিন্তু প্যাট কামিন্স কথা রাখলেন এরপর। স্তব্ধ করলেন আহমেদাবাদের লাখো সমর্থকদের।
পরে স্বাগতিকদের হতাশ করেন রাহুল, সূর্যকুমার যাদবরাও। পুরো বিশ্বকাপজুড়ে অপ্রতিরোধ্য ভারতের ব্যাটিং ফাইনালে এসে আড়াইশ রানও করতে পারেনি। রোববার নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়াকে সব উইকেট হারিয়ে ২৪১ রানের লক্ষ্য দিয়েছেন রোহিত-কোহলিরা। ইনিংসের পঞ্চম ওভারে এসে প্রথম উইকেটটা পেয়ে যায় অস্ট্রেলয়া। উইকেটে খুব একটা ক্যারি না থাকায় এর আগে অল্পের জন্য স্লিপে ক্যাচ হওয়া থেকে বাঁচেন শুভমন গিল। কিন্তু স্টার্কের শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে ব্যাটের ঠিক জায়গায় লাগাতে পারেননি। ৭ বলে ৪ রান করে মিড অনে দাঁড়ানো অ্যাডাম জ্যাম্পার ক্যাচ হয়ে ফিরে যান সাজঘরে। তার বিদায়ের পরও রোহিত শর্মা রানের গতি রেখেছিলেন ঠিকঠাক। পাওয়ার প্লের ১০ ওভারে ভারত তোলে ৮০ রান। কিন্তু এর মধ্যে তাদের হারাতে হয় রোহিত শর্মার উইকেটও। ৪ চার ও ৩ ছক্কায় ৩১ বলে ৪৭ রান করে পার্ট-টাইম স্পিনার ম্যাক্সওয়েলের বল তুলে মারেন তিনি। বল উঠে যায় বেশি উপরে, কাভার থেকে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে দারুণ এক ক্যাচ ধরেন ট্রাভিস হেড। শ্রেয়াস আয়ারও দ্রুত ফিরলে বিপদেই পড়ে যায় ভারত। ৩ বলে ৪ রান করে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন তিনি, তার উইকেট নেন অজি অধিনায়ক কামিন্স। শ্রেয়াসের বিদায়ের পর রাহুলকে নিয়ে ধীরে ধীরে দলকে টেনে তোলেন বিরাট কোহলি। এর মধ্যে তিনি তুলে নেন হাফ সেঞ্চুরি।
এই বিশ্বকাপে কোনো ব্যাটার ছয়শও রান করতে পারেনি, তিনি ছুটছিলেন আটশ রানের দিকে। কিন্তু এবারও অস্ট্রেলিয়ার ত্রাতা হন অধিনায়ক কামিন্স। আগের দিন তিনি বলেছিলেন, আহমেদাবাদের লাখের বেশি সমর্থককে চুপ করিয়ে দিতে চান। সেটি কোহলিকে ফিরিয়ে করে দেখান কামিন্স। তার শর্ট বল কাট করতে গিয়ে কোহলির ব্যাটে লেগে স্টাম্পে যায়। অবিশ্বাসের চোখ নিয়ে ক্রিজে কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। এই বিশ্বকাপের ১১ ম্যাচে ৯৫.৬২ গড় ও ৯০.৩১ স্ট্রাইক রেটে ৭৬৫ রান করেছেন। রোহিত শর্মা ৫৯৫ রান করে আছেন দুইয়ে। কোহলির সঙ্গে ৬৭ রানের জুটি ভাঙার পরও রাহুল ‘এংকরিংটা’ ঠিকঠাকই করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু স্টার্কের দুর্দান্ত এক বলে আর টিকতে পারেননি তিনি। ১০৭ বল খেলে স্রেফ একটি বাউন্ডারি হাঁকানো রাহুল করেন ৬৬ রান। তার বিদায়ের পর সব আশাই ছিল সূর্যকুমার যাদবকে ঘিরে। কিন্তু তাকে স্লো বল করে বিপাকে ফেলে দেয় অস্ট্রেলিয়া। আলো না ছড়িয়েই সাজঘরে ফেরত যান সূর্য। ২৮ বলে ১৮ রান করে হ্যাজেলউডের শিকার হন তিনি। এরপর শেষ উইকেট জুটিতে যোগ হয় আরও ১৪ রান। ১৮ বলে ১০ রান করে ইনিংসের শেষ বলে রান আউট হন কুলদিপ যাদব। ৯ রানে অপরাজিত থাকেন মোহাম্মদ সিরাজ। বল হাতে অস্টেলিয়ার স্টার্ক ৩টি এবং হ্যাজেলউড ও কামিন্স ২টি করে উইকেট তুলে নিয়েছেন। এছাড়া ম্যাক্সওয়েল ও জাম্পার ঝুলিতে গেছে ১টি করে উইকেট।