মানুষকে পারস্পরিক সুসম্পর্ক, বন্ধুত্ব বা সদ্ভাব বজায় রাখার শিক্ষা দেয় ইসলাম। এই শিক্ষা মানুষের জন্য অমূল্য। একে কাজে লাগিয়ে যেকোনো লিঙ্গ, বর্ণ, গোত্র ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে আন্তরিক হওয়া যায় এবং অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব বজায় রাখা যায়। ফলে শত্রুতা দূর হয় এবং সমাজে শান্তি বিরাজ করে। এখানে কোরআন-হাাদিসের আলোকে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার বা সুসম্পর্ক বজায় রাখার বিশেষ ১০টি শিক্ষা তুলে ধরা হলো।
১. সাক্ষাতে সালাম দেওয়া
সালাম ইসলামে সর্বোত্তম ও একমাত্র অভিবাদন। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, মমত্ববোধ, দায়িত্ববোধ ও সহমর্মিতা জাগ্রত করে সালাম। দূর করে মানব-মনের অহংকার, হিংসা বিদ্বেষ ও অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা। সালামের মাধ্যমে যেমন পরস্পরের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় তেমন আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও সওয়াব লাভ করা যায়। বিভিন্ন হাদিসে সালামের ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। জান্নাতেও সালামের প্রচলন থাকবে। মুসলিমরা জান্নাতে যাওয়ার সময় ফেরেশতারা বলবেন, ‘তোমাদের প্রতি সালাম’, তোমরা সুখী হও’ (সুরা জুমার: ৭৩)। এক জান্নাতি অপর জান্নাতিকে সালাম দেবে। ‘সেখানে তাদের অভিবাদন হবে সালাম’ (সুরা ইউনুস: ১০)। মহান আল্লাহ তাআলাও জান্নাতিদের সালাম দেবেন। ‘সালাম, পরম দয়ালু প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সম্ভাষণ।’ (সুরা ইয়াসিন: ৫৮)
আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বলেন, নবীজি (স.) মদিনায় পদার্পণ করে সর্বপ্রথম যে কথা বলেছেন, তা হলো—‘হে লোক সকল, তোমরা পরস্পর সালাম বিনিময় করো, অভুক্তকে আহার করাও, গভীর রাতে সালাত আদায় করো।’ (তিরমিজি: ২৪৮৫)
২. মানুষকে খাওয়ানো
মানুষকে খাওয়ানোর কারণে একের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধা-ভালবাসা, আন্তরিকতা ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া এটি উত্তম আমল। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞেস করল, ইসলামে কোন জিনিসটি উত্তম? তিনি বলেন, তুমি খাদ্য খাওয়াবে ও চেনা-অচেনা সবাইকে সালাম দেবে। (বুখারি: ১২)
৩. সুপরামর্শ দেওয়া ও চাওয়া
নবীজি (স.) তাঁর শিষ্যদের সর্বদা ভ্রাতৃত্ব ভালোবাসা সম্মান ও সম্ভ্রম, উপাসনা, আনুগত্য, আদবকায়দার শিক্ষা দিতেন এবং এসব নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলার জন্য প্রেরণা, উৎসাহ ও পরামর্শ দান করতেন। নিজেও সবার সঙ্গে পরামর্শ করতেন। এককভাবে কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকার পরও রাসুলুল্লাহ (স.) সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজের সিদ্ধান্ত নিতেন। ফলে তাঁর কাজকর্ম সবার কাছে গ্রহণীয় ও যথাযথ হয়ে উঠত। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘কাজের বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। যদি গুরুত্ববহ কাজের সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)
৪. মানুষের অধিকার রক্ষা করা
যার যার অধিকার তাকে দেওয়া ভালোবাসা ও সম্মান লাভের উপায়। কারো সম্পদ হরণ করা, অন্যায়ভাবে মানসিক চাপ প্রয়োগ করা ইত্যাদি হারাম। বরং সব মুসলমানকে ভাই মনে করতে হবে এবং ভাইয়ের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করতে হবে। তাহলেই অধিকার রক্ষা করা হবে। মুসলমানদের অধিকার সম্পর্কে নুমান ইবনে বশির (র.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, সব মুসলিম একজন ব্যক্তি সমতুল্য। যদি তার চক্ষু পীড়িত হয়, তবে তার সমগ্র দেহ পীড়িত হয়ে পড়ে। যদি তার মাথা আক্রান্ত হয় তাহলে সমগ্র শরীরই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। (সহিহ মুসলিম: ৬৪৮৩)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, এক মুমিন আর এক মুমিনের জন্য ইমারততুল্য, যার এক অংশ আরেক অংশকে সুদৃঢ় করে। আর তিনি (স.) তাঁর এক হাতের আঙুল আরেক হাতের আঙুলে প্রবেশ করিয়ে দেখালেন। (সহিহ বুখারি: ২৪৪৬) নবীজি আরো বলেছেন, যখন (সাহাবিরা) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, ইসলামে কোন জিনিসটি উত্তম? তিনি বলেন, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে। (সহিহ বুখারি: ১১)
প্রতিবেশীর অধিকার প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ওই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যার প্রতিবেশী তার অন্যায়-অত্যাচার থেকে নিরাপদ নয়। (সহিহ মুসলিম: ৭৬)
৫. হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার
হিংসা বিদ্বেষ পরিহার করতে পারলে ভালোবাসা লাভ হয় এবং শত্রুতা জন্মায় না। আর এজন্যই নবীজি পরস্পর হিংসা বিদ্বেষ রাগ করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমরা পরস্পর বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হইয়ো না, হিংসা করো না এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন থেকো না। আর তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ও পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও। কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে সে তার ভাই থেকে তিন দিনের অধিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে থাকবে। (সহিহ বুখারি: ৬০৭৬)
৬. দয়া ও ভালোবাসা
পরস্পর দয়ার গুরুত্ব রয়েছে ইসলামে। প্রিয়নবী (স.) বলেছেন, তোমরা বিশ্ববাসীদের প্রতি সদয় হও, তখন আকাশবাসী অর্থাৎ আল্লাহও তোমাদের প্রতি সদয় হবেন। এজন্য তিনি পরস্পর দান-সদকার কথা বলেছেন। তিনি দান-সদকার প্রতি উৎসাহ দিতে গিয়ে বলেন, সদকা এবং দান খয়রাত পাপকে এমনভাবে মুছে দেয়, যেমন পানি আগুনকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। হাদিসে এসেছে, আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন, যে মুসলিম কোনো বস্ত্রহীন মুসলিমকে কাপড় পরাবে, মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ পোশাক পরাবেন। যে মুসলিম কোনো অভুক্ত মুসলমানকে আহার করাবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল-ফলাদি খাওয়াবেন। আর যে মুসলিম কোনো পিপাসু মুসলিমকে পানি পান করাবে, মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতের সিলমোহরকৃত বিশুদ্ধ পানীয় পান করাবেন। (সুনানে আবু দাউদ: ১৬৮২)
৭. মন্দের প্রতিউত্তরে উত্তম আচরণ
মন্দ আচরণের প্রতিউত্তরে সুন্দর আচরণ সুসম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে একটি কার্যকরী আমল। এ আমল করতেন স্বয়ং নবীজি (স.)। এ আমল ছিল সাহাবায়ে কেরামের জীবনে। তাবেঈন, তাবে তাবেঈন ও আউলিয়ায়ে কেরামের জীবনেও রয়েছে মন্দের উত্তরে উৎকৃষ্ট আচরণের হাজারো প্রমাণ। এই সুন্দর আমলটির নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেছেন- ‘মন্দ কথার প্রতি উত্তরে তাই বলুন; যা উত্তম। আমি সেই বিষয়েও সবিশেষ অবগত; তারা যা বলে।’ (সুরা মুমিনুন: ৯৬)
অন্য আয়াতে এসেছে- ‘সব ভালো ও মন্দ পরস্পর সমান নয়। আপনি মন্দের জবাবে ওই কথা বলুন; যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সঙ্গে যে ব্যক্তির শত্রুতা রয়েছে, সেও যেন আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা হামিম: ৩৪)
৮. সুসম্পর্ক গঠনে প্ররোচনামুক্ত থাকার দোয়া
মানুষ যত মন্দ কথা বলে; এর উদ্ভাবক হচ্ছে বিতাড়িত শয়তান। এ কারণেই মহান আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে মানুষের মন্দ কথা জবাবে উত্তম কথা বলার নসিহত পেশ করেছেন। আর আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তানের প্ররোচনায় মন্দ কথা, কাজ ও আচরণ থেকে বিরত থাকতে তিনি নবীজিকে এ মর্মে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা দোয়া শিখিয়েছেন- رَّبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ উচ্চারণ: ‘রাব্বি আউজুবিকা মিন হামাযাতিশ শায়াত্বিন।’ অর্থ: ‘হে আমার প্রভু! আমি শয়তানের প্ররোচনা (মন্দ কথা) থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (সুরা মুমিনুন: ৯৭)
৯. বিপদে পাশে দাঁড়ানো
মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো মহান ইবাদত। এই ইবাদতে একইসঙ্গে মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান লাভ হয় এবং আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ লাভ হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন, ‘দয়াশীলদের ওপর করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদেরকে দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ: ৪৯৪১)
অন্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা নিজের সম্পদ দিনে বা রাতে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে আল্লাহর পথে খরচ করে তাদের পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের কাছে আছে। তাদের কোনো ভয় নেই। তাদের কোনো চিন্তাও নেই।’ (সুরা বাকারা: ২৭৪)
১০. হাদিয়া দেওয়া
নবীজি (স.) বলেন, ‘তোমরা পরস্পর হাদিয়া আদান-প্রদান করো, তাহলে মহব্বত বৃদ্ধি পাবে।’ (আল আদাবুল মুফরাদ: ৫৯৪) হাদিয়া হিংসা দূর করারও বড় উপায়। রাসুল (স.) বলেন, ‘তোমরা পরস্পরে হাদিয়া বিনিময় করো; এর দ্বারা অন্তরের সঙ্কীর্ণতা ও হিংসা দূর হয়ে যায়।’ (মুসনাদে আহমদ: ৯২৫০)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে সুসম্পর্ক বজায় রাখার তাওফিক দান করুন। ইসলামের উত্তম নসিহত মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।