আগামীতে জ্বালানি তেল ডিজেল, পেট্রোল ও অকেটেনে আর কোনো ভর্তুকি দেবে না সরকার। জ্বালানি তেলকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে দেশেও বাড়বে। আর কমলে এখানেও কমবে। পাশাপাশি ৩ মাস পর পর দর সমন্বয় করার নীতিগত সিদ্ধান্তও নিতে যাচ্ছে সরকার।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেও এই পরিকল্পনার তথ্য পরিষ্কার হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এতদিন আমাদের অর্থ ছিল আমরা ভর্তুকি দিয়েছি। কিন্তু করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে মন্দা দেখা দিয়েছে তাতে আমরাও আক্রান্ত। সুতরাং এতদিন বিদ্যুৎ এবং গ্যাসে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। সেই ভর্তুক্তির টাকা এখন আপনাদের দিতে হবে।
জানা যায়, দাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে এলপি গ্যাসের দর পদ্ধতিকে মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এলপিজির দর প্রতিমাসে নির্ধারণ করা হলেও জ্বালানি তেলের দাম ৩ মাস পর পর দর চূড়ান্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গণশুনানির প্রতিমাসে এলপিজির দর নির্ধারণ করে আসছে। তেমনি ডিজেল পেট্রোলের ক্ষেত্রেও এমন পদ্ধতি অনুসরণের কথা ভাবা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে পরিচালন খরচ ও আমদানি ব্যয় আলাদা করা হবে। পরিচালন খরচ অপরিবর্তিত থাকবে আর, ৩ মাস পর আন্তর্জাতিক বাজারের দরের সঙ্গে কমবেশি হবে দেশের জ্বালানি তেলের বাজারদর। বিইআরসি যাতে আইনী কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজটি করতে পারে, সে জন্য ঝুলে থাকা বিইআরসি প্রবিধানমালার সংশোধনীসহ চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিইআরসি আইনের আলোকে ২০১২ সালে প্রবিধানমালার খসড়া করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও তা এখনও ঝুলে আছে। ঝুলে থাকা প্রবিধানমালায় প্রয়োজনে পরিমার্জন করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিগগিরই এ বিষয়টি দৃশ্যমান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে যে পদ্ধতিতেই হোক সরকার জ্বালানি তেলে ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসতে বদ্ধ পরিকর।
এদিকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা। তবে তারা কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। যদিও সরকারের ভর্তুকির হিসেব নিয়ে অনেকের দ্বিমত রয়েছে। তারা মনে করে উচ্চহারে ট্যাক্স আদায় করা হচ্ছে, অন্যদিকে বলা হচ্ছে ভর্তুকির কথা। এটা এক ধরনের ছলচালুতির মতোই। ট্যাক্স দিয়েও মুনাফা করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। কিছু পণ্যের উপর ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত ট্যাক্স-ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। অর্থাৎ ১০০ টাকার মধ্যে ৩৪ টাকাই ডিউটি নেওয়া হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ট্যাক্সও বেড়ে যাচ্ছে। দামের পরিবর্তে পণ্যের পরিমাপের উপর ট্যাক্স-ভ্যাট নির্ধারণ করার দাবি জানিয়ে আসছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
বর্তমানে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দর নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। একক পাইকারি বিক্রেতা হচ্ছে বিপিসি। তারা নিজেরা আমদানি করছে পাশাপাশি দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উপজাত (কনডেনসেট) থেকে পাওয়া পেট্রোল, অকটেন রাষ্ট্রীয় কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মাধ্যমে বাজারজাত করে আসছে। পেট্রোল কিছুটা আমদানি করা হলে অকটেন দেশীয় গ্যাস ফিল্ড থেকে পাওয়া যাচ্ছে। মূলত বিপুল পরিমাণ ডিজেল আমদানি করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। সরাসরি ডিজেলের পাশাপাশি ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত তেল (ক্রড) আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। সরকার বছরে আরও ৩০ লাখ টন পরিশোধনের লক্ষে ইআরএল ইউনিট-২ নির্মাণে প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থ বছরে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিল ৬২ লাখ ৯৯ হাজার ৭৩০ মে. টন। খাত ভিত্তিক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে পরিবহন খাতে, ওই অর্থ বছরে ৬২.৯২ শতাংশ সমান ৩৯ লাখ ৬৩ হাজার ৭২৫ মে.টন ব্যবহৃত হয়েছে। এরপরেই রয়েছে কৃষি খাতে ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৬০৪ মে. টন, বিদ্যুৎ খাতে চাহিদা ছিল ৬ লাখ ৫২ হাজার ৬৬ মে. টন। শিল্পে ৪ লাখ ৫০ হাজার ৪৩৭ মে.টন. গৃহস্থালীতে ৯৭ হাজার ৬০০ টন এবং অন্যান্য খাতে ১ লাখ ৬০ হাজার ২৯৮ মে.টন।
তবে অনেকেই মনে করেন, জ্বালানি তেলের এই চাহিদার সূচক এখন নিম্নগামী হবে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের কারণে সেচের চাহিদা কমে আসবে, অন্যদিকে পরিবহনেও আসছে বৈদ্যুতিক যানবাহন, সেখানেও চাহিদা কমে আসবে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, আমরা জ্বালানি তেলের বাজার উন্মুক্ত করার কথা চিন্তা করছি। এখানে সরকারি কোম্পানির পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও থাকতে পারে। একটি মেকানিজম করার চেষ্টা করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশেও বাড়বে, আর কমে গেলে দেশেও কমে যাবে। তবে মূলকথা হচ্ছে সরকার জ্বালানি তেলে আর ভর্তুকি দিতে চায় না।