শিরোনাম: |
বাজারে টিসিবি ও মনিটরিং স্কোয়াড দরকার
মোল্লা জালাল
|
![]() উমিচাঁদ, রায় দুর্লভ, জগৎ শেঠ গং বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ- দৌলার পতনের ইতিহাস বহুমাত্রিক। উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, রাজবল্লভ, ইয়ার লতিফ গং কেউ রাজনীতির লোক ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন বাজারি। ব্যবসার নামে মুনাফার সন্ধান করতেন। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বড় মুনাফার লোভ দেখালে তারা-ই মীর জাফর-মির মদনদের জন্ম দেয়। প্রতিহিংসাপরায়ণ নারী ঘসেটি বেগমতো ছিলই। ইংরেজদের মদদে তারা চক্রান্ত করে সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষকে দুই শ বছরের গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার পথ সুগম করে দেয়। এখন সে যুগ না থাকলেও এ যুগেও উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, রাজবল্লভ, ইয়ার লতিফ গংদের প্রেতারা মীর জাফর-মির মদনদের জন্ম দেওয়ার অপচেষ্টা থেকে বিরত হয়নি। সামনে কোরবানির ঈদ। এরই মাঝে খবর বেরিয়েছে বাজারে হুহু করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। পিঁয়াজে প্রতি কেজিতে বেড়ে গেছে ১০-১২ টাকা। মশলাপাতিতে আগুন লাগা অবস্থা। চট্টগ্রামের আড়তদাররা বলছেন, বন্যার কারণে না-কি সরবরাহ কমে গেছে। কি অদ্ভুত যুক্তি। সরকার বলছে বাজারে পর্যাপ্ত মওজুদ রয়েছে। চাল, ডাল, আদা, রসুন, পিঁয়াজ, মরিচ, তেল, নুন, কোনো কিছুর অভাব নেই। অপরদিকে দেশীয় পিঁয়াজ উৎপাদনের অঞ্চলগুলোতে বন্যা নেই। তাহলে দাম বাড়বে কেন? এদেশে প্রতিটি উৎসব এবং বিশেষ সময়ে একশ্রেণির মুনাফাখোর পকেট কাটে, বাজার লুটে। সরকার হুঁশিয়ারি দেয়, অভিযান চালায়। তাতে জিনিসপত্রের দাম কমে না। গণমাধ্যমে নিয়মিত রিপোর্ট হয়, বাজার নিয়ে রাজনীতি গরম হয় কিন্তু দাম বাড়তেই থাকে। কেউ বলে ‘সিন্ডিকেড’ বাজার চালায়। কারো মতে, সরকারের নীতি নির্ধারকদের অনেকে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোয় সহযোগিতা করে। আরো কত কথা। কিন্তু মানুষের ভোগান্তি কমে না। বাজার নিয়ন্ত্রণ ‘পদ্মা সেতু’ গোটা দেশকে যেভাবে জাগিয়ে তুলেছে তা অভূতপূর্ব। জাতির এই উচ্ছ্বাসের মধ্যে যেমন সাহস ও শক্তি আছে, তেমনি এর বিপরীতে ঝুঁকিও কম নেই। সেই ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে সামনে এগুতে হবে। সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলায় এমনকি পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোকেও মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হলে আপনা থেকেই মুনাফাখোর চক্র দমন হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের মনে প্রতিবাদের সাহস বাড়বে, সংযমী হবে। মনিটরিং স্কোয়াড সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিশেষ বাহিনি বানিয়েছে। তাদের তৎপরতায় দেশে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা কমে গেছে। দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে নিয়মিত মনিটরিং করার জন্য সময়ের প্রয়োজনেই একটি বিশেষ বাহিনি করা হলে দোষের কি আছে। নতুন কোনো বাহিনী বানানোয় সমস্যা থাকলে র্যাব সদস্যদের মধ্যে থেকেই ‘র্যাব স্কোয়াড’ করা যেতে পারে। তাদের দেখলেই যেন বুঝা যায় ‘বাজার মনিটরিং স্কোয়াড’। ওই রকম ইউনিফর্মড কোনো বাহিনি থাকলে সাধারণ মানুষ তাদের কাছে কোথায়, কারা জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে জানাতে পারবে। মোদ্দাকথা কাউকে ধরপাকড় করতে হবেনা, ‘র্যাব’ এর মতো ওই বাহিনির টহলেই বাজার স্থিতিশীল থাকবে। তাছাড়াও সরকারের লোকের অভাব নেই। বহু ডিপার্টমেন্ট আছে সারদেশে যাদের বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। বলতে গেলে তারা সারাবছর শুধু বসে বসে বেতন খায় আর ভাউচার বানায়। তাদেরকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। বৈশ্বিক মন্দা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। ভোগ-বিলাসি ইউরোপীয় সমাজের ঘরে ঘরে বেকারত্ব। জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বি। তারা এখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে শরনার্থী কি জিনিস। এই সংকটের মধ্যে দিয়েও একশ্রেণির মানুষ বেসুমার অর্থ-বিত্তের মালিক হচ্ছে। বাংলাদেশেও মুনাফাখোর শ্রেণি যুদ্ধের বাজারে মুনাফার জন্য আঙ্গুলের কড়া গুনতে শুরু করেছে। তাদের কাছে আমদানি করা পণ্য আর দেশিয় পণ্যের কোনো বাছ-বিচার নেই। টার্গেট হচ্ছে এই সুযোগে পকেট কাটবে, বাজার লুটবে, পাচার করবে। দেশের প্রকৃত ব্যবসায়ী সমাজকে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা দুর্বৃত্তায়নের কারণে দিনকে দিন ব্যবসায়ী সমাজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বহু নজির আছে, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় একশ্রেণির লোক সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে। আন্তর্জাতিক লুটেরা চক্রের ওই লুটের সম্পদ রক্ষার নিরাপদ রক্ষক ‘সুইস ব্যাংক’। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমানো টাকার পরিমাণ প্রায় ৮ লাখ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত এক বছরেই জমা হয়েছে সবচেয়ে বেশি টাকা। এ হিসাব শুধু নগদে জমানো টাকার। এর বাইরে সোন-দানা, হীরা, মনি-মুক্তার হিসাব আলাদা। গত দুই বছর দেশ করোনায় আক্রান্ত। ব্যবসা-বাণিজ্য জীবন-জীবিকা সব কিছু প্রায় অচল ছিল। তারপরও এত বিপুল পরিমাণ টাকা সুইস ব্যাংকে গেল কিভাবে। কারা, কোথা থেকে কিভাবে এত টাকা পাচার করলো এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। মোটা দাগে এর জবাব হচ্ছে ব্যাংক ও বাজার লুট করে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে। আরো পাচার হবে, হতেই থাকবে যদিনা প্রতিরোধের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। সারাবছর টিসিবি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে কাউকে বাধা দেওয়া বা শাস্তি দিয়ে শত্র“তা বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। সরকার সারাদেশে টিসিবি’র পণ্য বিক্রি শুরু করেছে। বলা হচ্ছে, এটা চলবে ১০ জুলাই পর্যন্ত। কেন সারা বছর ধরে চলতে সমস্যা কোথায়? সরকার বাজার থেকে ন্যায্য মূল্যে পণ্য কিনে খরচ বাদে সর্বসাধারণের কাছে উন্মক্ত বাজারে বিক্রি করবে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর অজুহাতে মুনাফাখোররা যুক্তি দেখায় আমদানি মূল্য বেশি হওয়ার কারনে তারা দাম বাড়াতে বাধ্য হয়। এ নিয়ে তর্ক করে আখেরে কোনো সমাধান পাওয়া যাবেনা। তারা তাদের মতো আমদানিকৃত পণ্যের দাম নির্ধারণ করুক। সরকার নিজে নিত্য প্রয়োজনীয় জরুরি পন্য আমদানি করে টিসিবি’র মাধ্যমে সারাদেশের খোলাবাজারে বিক্রি করলে কারো কিছু বলার থাকবেনা। টিসিবির দোকান থেকে সর্বস্তরের মানুষ প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারলে বাজার লুটেরা মুনাফাখোরদের কিছুই করার থাকবেনা। সাধারণ মানুষের চাহিদা শুধু চাল, ডাল, তেল, নুন, পিঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুনের। এসব পণ্য বেসরকারি খতের পাশাপাশি সরকার নিজেই আমদানি করে টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি করলে সারাবছর বাজার স্থিতিশীল থাকবে। ভোক্তা অধিকার দপ্তর ভোক্তা অধিকার দপ্তরকে আরো বেশি ক্ষমতা ও দায়িত্ব দিয়ে তাদের কার্যক্রম দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করা দরকার। শুধুমাত্র ঢাকা বা চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক না হয়ে সয়াবিন তেল মওজুদ কারিদের বিরুদ্ধে যেমন অভিযান চলছিল, সারাবছর ধরে সেরকম অভিযান চালানো এখন সময়ের দাবি। কথায় বলে ‘চোরে না শুনে ধর্মের বাণী’। মুনাফাখোর শ্রেণি স্বাভাবিক মানুষ নয়। এরা মানুষের মুখ দেখেনা, পকেট হাতায়। ভোক্তা অধিকার দফতরকে সক্রিয় করা হলে বাজার স্থিতিশীল থাকতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত তবে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে একক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ এটা প্রমাণিত ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত থাকে’। ভাবতে অবাক লাগে বাংলায় লেখাপাড়া করা একজন মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বুঝেন তা এদেশের বড়বড় ডিগ্রিধারী বাঘা বাঘা ইঞ্জিনিয়াররা কল্পনাও করতে পারেন না। সিলেটে বন্যার পানি দ্রুত সরে যাওয়ার জন্য তিনি গ্রামের মানুষের মতো বলে দিলেন, ‘সড়ক কেটে দাও’। পরে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামতের প্রশ্নে বললেন, ‘সড়কের ভাঙ্গা অংশ মেরামত নয়, ব্রিজ কালভার্ট কর’। আবার রেল ক্রসিংয়ের জায়গায় ‘আন্ডার এবং ওভার ব্রিজ’ করতে বললেন। কত সহজ এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের দূরদর্শী নির্দেশনা। এগুলো শুনে আমাদের দেশের তথাকথিত ইঞ্জিনিয়াররা কি লজ্জা পায়না। না দিনের পর দিন ‘চুরির রাস্তা’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকায় তারা শঙ্কিত। আমলাতন্ত্রের মধ্যে যাদের এখনো হুঁশজ্ঞান আছে তাদের উচিত একটু নড়েচরে বসা। কেননা সাধারণ মানুষ এখন অনেক কিছুই বুঝে। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের উচিত হবে কূটচাল না চেলে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সময়োচিত সিদ্ধান্ত কার্যকর করা। মাত্র একটি বছর মাত্র একটি বছর সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে তার বহুমাত্রিক সুফল পাবে দেশবাসী তথা রাজনীতি। ‘পদ্মা সেতু’ জাতির মনে যে সাহস ও প্রত্যাশা জাগিয়েছে সেটাকে ধরে রাখার মাধ্যমে আগামীর বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কোনো বিকল্প নেই। ‘বাজার’ স্থিতিশীল থাকলে দেশের সকল ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা থাকবে। দেশে-বিদেশে দৌড়া-দৌড়ি কিংবা লবিং গ্র“পিং করে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করা যাবেনা। বাংলাদেশের নির্বাচন কিংবা উন্নয়ন বিষয়ে ‘মোড়লদের’ দেওয়া উদ্দেশ্যমূলক জ্ঞানে কোন কাজ হবে না। রাজনীতিতে ঐক্য হয় না রাজনীতিতে কোনোদিনও ঐক্য হয় না। সে কারণে সব সময়ই এক দল আরেক দলের প্রতিপক্ষ। নইলে সব দল মিলে এক দল হয়ে যেতো। মানব সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে যুদ্ধ বিগ্রহ মারামারি কাটাকাটি খুন-খারাবির মধ্যে দিয়ে। আগের দিনে একদেশের শাসকরা আরেক দেশ আক্রমণ করে প্রতিপক্ষকে হত্যা করে নিজেদের শাসন কায়েম করতো। এই উপমহাদেশে মোগল, পাঠান, বৃটিশদের ইতিহাস তার সাক্ষী। তখনকার দিনে নেতৃত্বের ব্যক্তিত্ব ছিল। এখন নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার পর দেশবাসীর সামনে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নেতৃত্বের কোনো মুখ নেই। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্বই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান বিশ্বে সর্বজন স্বীকৃত একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ। তিনি প্রমাণ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বীরের জাতি বাঙালির ‘বাংলাদেশ পারে’। এই সক্ষমতার মর্যাদা ধরে রাখার জন্যই দরকার দেশপ্রেমিক মানুষের জাতীয় ঐক্য। রাজনীতির ফসল ভাগা-ভাগি বা বেনিফিসিয়ারিদের সমঝোতায় প্রয়োজনে জোড়াতালি দিয়ে সরকার বানানো যায়। কিন্তু সে ধরনের সরকারের ভিতরে ‘শক্তি’ থাকেনা। সংযুক্তরা শুধু ‘খাই খাই, নাই নাই, যাই যাই’ করে। সরকারের ভিতরের একেক জন একেক সুরে কথা বলায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। তাই দলের নয়, ঐক্য দরকার সাধারণ মানুষের। যা ‘পদ্মা সেতু’র উচ্ছ্বাসে প্রকাশিত হয়েছে। মাত্র একটি বছর বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আগামীর বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে বিশ্বের মানচিত্রে নিজেদের সক্ষমতায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। দেশের সকল শ্রেণি-পেশার সব মানুষের এখন উচ্চৈঃস্বরে সে কথা বলার সময় এসেছে। লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, বিএফইউজে’র সাবেক সভাপতি |